
মইনুল হক বরাকবাণী প্রতিনিধি শ্রীভূমি ১৬মে: মহাত্মা গান্ধীর ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর স্বপ্ন ছিল এক স্বনির্ভর, স্বচ্ছ এবং জনগণমুখী শাসনব্যবস্থার। সেই আদর্শকে সামনে রেখে রাজ্যের জনগণ বহু প্রত্যাশা নিয়ে পঞ্চায়েত স্তরের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে থাকেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো।
পঞ্চায়েত ভোটের ফল প্রকাশের পরই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে চিত্র উঠে আসছে, তা হতাশাজনক এবং গণতন্ত্রের জন্য এক ভয়ানক অশনিসংকেত। ভোটগণনার মাত্র ক’দিন পেরোতেই বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ সামনে এসেছে।

নির্বাচিত একাধিক ওয়ার্ড সদস্য/সদস্যা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, জিপি সভাপতির পদে সমর্থনের বিনিময়ে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাবি করা হচ্ছে। শুধুমাত্র পদের মোহে নয়, অনেকেই যুক্তি দিচ্ছেন যে, ভোটে জয়লাভ করতে তারা জমি-মাটি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন, এখন সময় এসেছে সেই বিনিয়োগে মুনাফা তোলার!
এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায়, মহাকল গ্রাম পঞ্চায়েতের এক মহিলা ওয়ার্ড সদস্যা সরাসরি জানিয়েছেন, ১০ লক্ষ টাকা দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ৭ লক্ষ টাকায় সভাপতির সমর্থনে ভোট দেবেন। এখানেই প্রশ্ন উঠে, অর্থের বিনিময়ে ভোট দিয়ে নির্বাচিত একজন সদস্যা কতটা নিরপেক্ষ থেকে গ্রাম উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন?

ভোটের আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনতার সমর্থন আদায় করা হয়, তা কি টাকার গন্ধে হারিয়ে যাবে? এই প্রবণতা শুধু একটি অঞ্চলেই নয়। জেলার একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতে একই ছবি। অর্থের বিনিময়ে সমর্থন কেনাবেচার মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচন এখন যেন এক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। পঞ্চায়েত স্তরে জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলি রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, নিকাশী, স্বাস্থ্য ইত্যাদি—সমাধানের বদলে শুরু হচ্ছে পদ দখলের জন্য টাকার খেলা। ফলে যারা প্রকৃতই গ্রামোন্নয়নের কথা ভাবেন, তারা হয়ে পড়ছেন কোণঠাসা।
এলাকার সচেতন মহলের প্রশ্ন, যেখানে হাজার হাজার মানুষ এখনো বিদ্যুৎহীন, বিশুদ্ধ জলবিহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে পঞ্চায়েত সদস্যদের এই ‘লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা’ কতটা নৈতিক? এইভাবে সভাপতি নির্বাচন হলে, গ্রাম উন্নয়নের নামে কেবল দুর্নীতি আর আত্মস্বার্থ চরিতার্থ হবে, জনগণ থাকবে বঞ্চিতই।
বিশিষ্ট সমাজকর্মীরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সভাপতি বা সদস্যদের কাছ থেকে সৎ ও স্বচ্ছ প্রশাসন আশা করা কঠিন। জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দরকার কঠোর প্রশাসনিক নজরদারি ও স্বচ্ছ তদন্ত—যাতে জনগণের টাকায় গড়া পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে রক্ষা করা যায়। মহাত্মা গান্ধীর বহু আরাধ্য স্বপ্ন ছিল ‘গ্রাম স্বরাজ’—একটি স্বনির্ভর, স্বচ্ছ এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা।
সেই আদর্শকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষ যখন পঞ্চায়েত ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন, তখন তাদের মনে থাকে উন্নয়নের আশ্বাস, বঞ্চনার অবসান আর সুশাসনের স্বপ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ সেই স্বপ্নের সঙ্গে যেন নির্মম ঠাট্টা করা হচ্ছে—গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
যারা টাকার বিনিময়ে সমর্থন কিনে বা বিক্রি করে সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। না হলে জনগণের ভোটাধিকার এক হাস্যকর খেলায় পরিণত হবে, আর ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর সেই মহৎ স্বপ্ন শুধু বইয়ের পাতায়ই বন্দি থাকবে।