
মইনুল হক বরাকবাণী প্রতিনিধি শ্রীভুমি, ১৩ মেঃ সম্পূর্ণ করিমগঞ্জ জেলাজুড়ে এবারের জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একচেটিয়া দাপট লক্ষ করা গেছে। ষোলটি জেলা পরিষদ আসনের মধ্যে প্রায় এগারোটি আসনে একাই বাজিমাত করেছে বিজেপি। কংগ্রেস একমাত্র কিছুটা আশার আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দক্ষিণ করিমগঞ্জ ও উত্তর করিমগঞ্জ এলাকায়।
আজ সোমবার বিকেল প্রায় চারটার দিকে সমগ্র জেলায় ভোট গণণা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ফলাফলের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে, জেলা পরিষদ বোর্ড গঠনে বিজেপির হাতে থাকবে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে কংগ্রেসের সমর্থন আদায় করার কোনও প্রয়োজন পড়বে না বিজেপির। এই দৃশ্যপট একপ্রকার পরিষ্কার হয়ে গেছে।
তবে এবারের নির্বাচনে কয়েকটি আসন ছিলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে উমরপুর রাজাটিলা জেলা পরিষদ আসনটি নিয়ে নাটকীয়তার অভাব ছিল না। এই আসনে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন নবাগত মুখ জিল্লুন্নুর। কিন্তু তাকে হারাতে কংগ্রেসের অন্দরে থেকেই একাংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। বহু বছর কংগ্রেস ব্লক সভাপতির পদে থাকা আশুক উদ্দিন নিজেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন এবং জিল্লুন্নুরকে পরাজিত করার চেষ্টা চালান।
কিন্তু সব বিভাজন ও ষড়যন্ত্রের বিপরীতে কংগ্রেস নেতা আহমেদ সাহিল স্বপন এগিয়ে এসে দলের প্রার্থীর পাশে দাঁড়ান। দলীয় ঐক্য বজায় রেখে এবং তৃণমূলে পরিশ্রম করে তিনি একরকম নিজের কাঁধে তুলে নেন প্রার্থীকে। ফলত, সাহিল স্বপনের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং নেতৃত্বে জিল্লুন্নুর বিপুল ভোটে জয়ী হন। এতে করে রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন উঠেছে, আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর করিমগঞ্জ আসন থেকে কংগ্রেসের টিকিটের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন সাহিল স্বপন।

অন্যদিকে, শ্রীমন্ত কানিশাইল-বাশাইল জেলা পরিষদ আসনেও দেখা গেছে নাটকীয় মোড়। সেখানে কংগ্রেস প্রার্থী মুস্তাক আলীর পক্ষে ভোট না থাকার জল্পনা ছিল প্রবল, কারণ এলাকার মানুষ তাকে ‘বিজেপির প্রিয়’ প্রার্থী বলেই মনে করতেন। ফলে নির্দল প্রার্থী আহরার উদ্দিনের পক্ষে ছিল গণমত। তবে শেষরাতে বদরপুরের প্রাক্তন বিধায়ক জামাল উদ্দিন আহমেদের পুত্র জাকারিয়া আহমদ পান্না ময়দানে নামেন এবং মুস্তাকের পক্ষে প্রবল প্রচার চালান।
পান্নার এই ‘মরণ কামড়ে’ শেষ পর্যন্ত মুস্তাক মান রক্ষা করতে সক্ষম হন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ পান্নাকে কটাক্ষ করে বলছেন, বিজেপির লোককে জিতিয়ে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক কফিনে পেরেক ঠুকে দিলেন। এমনকি আহরার উদ্দিন নিজে ভোট গণনা শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, পান্না আগামী ছাব্বিশে কী মুখে ভোট চাইবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করে নিন। জনগণ বুঝিয়ে দেবে কত ধানে কত চাল।

এই আসরেই নির্দল প্রার্থী আহরার উদ্দিন ঘোষণা করেছেন, ২০২৬ সালে উত্তর করিমগঞ্জ বিধানসভা আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। পান্নার বিরুদ্ধে মানুষের রায় এবার স্পষ্ট হবে। এদিকে টিলাবাড়ি বান্দরকোনা জেলা পরিষদ আসনে কংগ্রেসের হয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন আইনজীবী মমতাজ বেগম। তার এই জয় রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
কারণ, তিনি পরাজিত করেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী সিদ্দিক আহমেদের ঘনিষ্ঠ আব্দুছ্ছত্তারকে। মমতাজের জয়ের ফলে দক্ষিণ করিমগঞ্জে কংগ্রেসের নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার ইঙ্গিত মিলেছে, এবং লোকমুখে এখনই চর্চা শুরু হয়েছে, আগামী ছাব্বিশে অতীত হয়ে যাবেন সিদ্দিক সাহেব। দক্ষিণ করিমগঞ্জের অন্য দুটি আসন কালীগঞ্জ জেলা পরিষদ আসনে কংগ্রেস প্রার্থী রিজু আহমেদ তালুকদার এবং লক্ষীবাজার আসনে কংগ্রেস প্রার্থী নিলুফা ইয়াসমিনও জয়লাভ করেছেন।
এই তিনটি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতেই বিজেপির আধিপত্য ছিল স্পষ্ট। মাইজগ্রাম সুপ্রাকান্দী, শ্রীগৌরী, চানকিরা, কানাইনগর-ফাকুয়া, লোয়াইরপুয়া, রাধে পেয়ারী, আনিপুর, ভৈরব নগর, চেরাগী, দুর্লভছড়া এবং নিলামবাজার জেলা পরিষদ আসন সবকটিই চলে যায় বিজেপির দখলে। উল্লেখযোগ্য যে, এসব আসনের অধিকাংশেই বিজেপি বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির এই নজরকাড়া ফলাফল পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য এক বড় পাথেয় হতে চলেছে। অন্যদিকে, কংগ্রেসের পক্ষে তৃণমূল স্তরে অনেক জায়গায় ভাঙন ও দ্বন্দ্ব থাকায় নির্বাচনী রণনীতি পুনর্বিবেচনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।সব মিলিয়ে বলা যায়, করিমগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবারের ফলাফল একদিকে যেমন বিজেপির জন্য স্বস্তির, অন্যদিকে কংগ্রেসের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে কিছু তরুণ নেতৃত্বের উত্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে।