
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর ৬মেঃ শহরতলীর ভাগাডহর-বরজুরাই এলাকার ই.এণ্ড.ডি নদী বাঁধ এখন জনদুর্ভোগের প্রতীক। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতেই বাঁধের একাধিক অংশ ধসে পড়েছে নদীগর্ভে, ফলে আশেপাশের জনপদ এখন চরম বিপদের মুখে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে। কিন্তু দু’বছর পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত শ্লথ, আর যা হয়েছে, তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, গোটা প্রকল্প জুড়ে চলছে দুর্নীতি, অপদার্থতা আর স্বজনপোষণের নোংরা খেলা। আর এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জল সম্পদ বিভাগের বাস্তুকার কে. ইউসুফ জামান।স্থানীয়দের অভিযোগ, বাস্তুকার কে. ইউসুফ জামান নিজের দায়িত্ব পালনের বদলে ঠিকাদারদের সঙ্গে আপোষ করে পুরো বাঁধ প্রকল্পটিকে সিন্ডিকেটরাজের আখড়ায় পরিণত করেছেন।
প্রতিবার তিনি এলাকা পরিদর্শনে এলেও শুধুমাত্র ঠিকাদারের সঙ্গে দু-চার কথা বলেই চলে যান—কাজের মান, নির্মাণসামগ্রীর গুণগত দিক, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি—এই কোনো কিছুই তিনি পর্যালোচনা করেন না। জনগণের অভিযোগ, মাটির বদলে নিম্নমানের ‘রাবিস মাটি’ব্যবহার করা হয়েছে বাঁধে, যা বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। বাস্তুকারকে এ বিষয়ে একাধিকবার জানানো হলেও তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে দায় এড়িয়ে গেছেন।

স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আমরা বলেছি বাঁধে রাবিস মাটি ব্যবহার করলে বৃষ্টি এলেই সব ধুয়ে যাবে। কথাটা বাস্তুকার সাহেবকে বলার পরও তিনি শুধু ঘাড় নেড়েছেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি। আজ সেটাই হয়েছে—মাটি সব ধুয়ে নদীতে চলে গেছে, বাঁধে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। অন্য এক প্রতিবাদকারী তরুণ জানান, এই বাস্তুকার ও ঠিকাদারের যোগসাজশে পুরো বাঁধের কাজ দুর্নীতির ছায়ায় চলছে।
তাঁকে না বদলালে এখানকার মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। সরকারকে অনুরোধ করছি—অবিলম্বে কে. ইউসুফ জামানকে অপসারণ করুন। না হলে আমরা বৃহত্তর গণআন্দোলনে নামব। স্থানীয় প্রশাসনকে কটাক্ষ করে এক শিক্ষক বলেন, আমাদের প্রাণ হাতে নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। এই বাঁধ ভেঙে গেলে শহরের বড় অংশ প্লাবিত হবে। এটা শুধুমাত্র ভাগাডহর বা বরজুরাইয়ের সমস্যা নয়—পুরো শিলচরের সমস্যা।

এখনই পদক্ষেপ না নিলে চরম মূল্য দিতে হবে। জনগণের অভিযোগ শুধু এখানেই থেমে নেই। তাঁরা আরও জানান, ২০২২ সালে বাঁধের সংস্কার শুরু হলেও আজ পর্যন্ত কাজের অর্ধেকও শেষ হয়নি। অথচ এই প্রকল্পের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন— কোথায় গেল সেই টাকা? কেন দুই বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হলো না? কীভাবে এমন নিম্নমানের কাজ চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়? কেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না? কেন এই গাফিলতি? এসব প্রশ্নের জবাব চায় জনতা।
সোমবার এলাকাবাসীরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেন। ক্ষুব্ধ জনতা বাস্তুকার ইউসুফ জামানের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলেন–দুর্নীতিগ্রস্ত বাস্তুকার হটাও, নদীবাঁধ রক্ষা করো!। তাঁরা অভিযোগ করেন, এই কর্মকর্তা সম্পূর্ণভাবে ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত, তাঁর কোনো প্রশাসনিক দক্ষতা বা মানবিক দায়বদ্ধতা নেই। একজন বলেন, আগত বর্ষার পদধ্বনিতে আমাদের ঘুম উড়ে গেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের রাত জেগে পাহারা দিতে হয়েছে, কখন বাঁধ ভেঙে ঘরে জল ঢুকে পড়ার আতঙ্কে তাড়া করছে এলাকাবাসীকে! অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন ঠিকাদারের সাথে আঁতাত করে। এভাবে আর চলতে পারে না। আমরা বদলি চাই, শাস্তি চাই।
বিভাগীয় উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে জনগণের স্পষ্ট দাবি, অবিলম্বে বাস্তুকার কে. ইউসুফ জামানকে বদলি করতে হবে, গোটা প্রকল্পের নির্মাণ কাজের তদন্ত করে দায়ী ঠিকাদার ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বাঁধ সংস্কারের কাজ পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু করতে হবে এবং গুণগত মান বজায় রাখতে হবে, প্রকল্পের প্রতিটি ধাপ জনসাধারণ ও মিডিয়ার সামনে স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
নচেত আন্দোলনের পথেই হাঁটবে এলাকাবাসী, এমন হুঁশিয়ারি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। বরজুরাই ও ভাগাডহরের জনজীবন এখন এক আতঙ্কের ছায়ায় ঢাকা। শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে চুপ—যা জনমানসে প্রশ্ন তুলছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্নীতির প্রতি নীরব প্রশ্রয়ের বিষয়েও।
ভাগাডহর-বরজুরাই বাঁধ কেবল একটি নির্মাণ প্রকল্প নয়, এটি হাজারো মানুষের বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িত। দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট ও স্বেচ্ছাচারী আধিকারিকদের হাতে যদি এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়, তাহলে আগামী দিনে আরও বড় বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে গোটা শিলচরকে।