
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর ২৬ জুলাইঃ নাগরিকত্বের প্রশ্নে বিভ্রান্তি, নিপীড়ন ও অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল কলকাতা। গতকাল সূর্যসেন স্ট্রিটের কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হলে এক ঐতিহাসিক নাগরিক সম্মেলনের আয়োজন করে পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৫০টি গণসংগঠন ও সমাজিক সংগঠন। সম্মেলনের মূল আহ্বায়ক ছিলেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও বর্ষীয়ান সংগ্রামী সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস।

জনসাধারণের স্বার্থে আয়োজিত এই সম্মেলনে রাজ্য তথা দেশের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত এক গভীর সংকট ও ষড়যন্ত্রের বাস্তবচিত্র উন্মোচিত হয়। সম্মেলনের সূচনায় আহ্বায়ক সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, দেশের এক বড় অংশের ভারতীয় নাগরিকদের উপর বিদেশি তকমা বসিয়ে তাদের নাগরিকত্ব, মর্যাদা ও মানবাধিকারকে হরণ করা হচ্ছে। বাংলাভাষীদের বিশেষভাবে নিশানা করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
সম্মেলনে বক্তারা বিশেষভাবে আলোকপাত করেন ভোটার তালিকার ‘Special Summary Revision’-এর নামে চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে, যা নতুন করে উদ্বেগ ও আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বাঙালি, বিশেষ করে বাংলাভাষীদের লক্ষ্য করে যেভাবে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে, তাতে নাগরিক অধিকারের উপর ঘনিয়ে এসেছে নতুন বিপদ। এই সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আসাম থেকে আগত নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সচিব-প্রধান সাধন পুরকায়স্থের বক্তব্য। তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রকাশ্যে বলেছেন, যারা আসামে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে লিখবেন, তাদের চিহ্নিত করাই হবে বিদেশি বাছাইয়ের সরল পথ।
এই বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, পুরো পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত জাতিগত নির্মূলের ষড়যন্ত্র। শ্রী পুরকায়স্থ আরও জানান, আসামে উচ্ছেদের নামে চলমান যে অপারেশন, তা একেবারে মানবাধিকার বিরোধী। শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী— কেউ রেহাই পাচ্ছেন না। খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন বহু পরিবার। বিনা পুনর্বাসনে সরকারি জমি থেকে বাংলা ভাষাভাষীদের উচ্ছেদ করে বাংলাদেশি অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। সাধনবাবু তথ্য তুলে ধরে বলেন, আসামে ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কাজ করছে, তারা নির্ধারণ করবে কে বিদেশি।
মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন নিজস্ব সিদ্ধান্তে মানুষকে বাংলাদেশি ঘোষণা করছেন, তখন আইনের কী মূল্য থাকছে? তিনি উল্লেখ করেন, আসামের ১৯ লক্ষ এনআরসি বাদ পড়াদের মধ্যে অধিকাংশই ভারতীয় নাগরিক। তাদের মধ্যে রয়েছেন দুইবারের প্রাক্তন বিধায়ক আতাউর রহমান মজহার ভূঁইয়া থেকে শুরু করে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদের পরিবারের সদস্যরাও। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এক বিশাল জনগোষ্ঠী এখন বঞ্চিত আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড সহ সকল নাগরিক অধিকার থেকে।
সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান তাঁর বক্তব্যে বলেন, আজ মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লি, উড়িষ্যা সহ বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী শ্রমিকদের বাংলাদেশি সাজিয়ে ধরপাকড়, মারধর ও অপমান করা হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে এনে আন্তর্জাতিক সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও দাবি করেন, আসামেও এমন ঘটনা ঘটেছে যেখানে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা হয়। পরে গুয়াহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে বিএসএফ-বিজিবি ফ্ল্যাগ মিটিং করে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়।
হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট আইনজীবীরা সেই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সম্মেলনের শেষভাগে সর্বসম্মতভাবে গঠিত হয় ‘নাগরিকত্ব সংঘর্ষ সমিতি’নামে একটি সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটি, যারা আগামী দিনে বৃহত্তর আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে মাঠে নামবে।
নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটি আসামের পক্ষ থেকেও এই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানানো হয়। সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মালদা থেকে আগত আরাফাত আলী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জীবন সরকার প্রমুখ। তাঁদের বক্তব্যেও ঘুরেফিরে উঠে আসে একটি কথাই এই লড়াই কেবল বাংলার নয়, এ লড়াই সমগ্র ভারতীয় জনতার অস্তিত্বের প্রশ্ন। সম্মেলনের শেষ প্রস্তাবে জানানো হয়, আমরা এমন একটি সর্বজনীন নাগরিকত্ব আইনের দাবি জানাচ্ছি, যা ধর্ম, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের মর্যাদা রক্ষা করবে। যেখানে কোনো মুখ্যমন্ত্রী নিজের ইচ্ছেমতো কাউকে বিদেশি ঘোষণা করতে পারবেন না।