
বরাকবাণী প্রতিবেদন গুয়াহাটি ২রা মেঃ অসমের কার্বি আংলঙ জেলার ডিফু শহরের বুকেই যেন গড়ে উঠছে এক নবযুগের রাজপ্রাসাদ। সুসজ্জিত অলিন্দ, সুউচ্চ স্তম্ভ, চকচকে মার্বেল আর চোখধাঁধানো স্থাপত্যশৈলী বাইরে থেকে দেখলে এটি যে কোনও রাজা-সম্রাটের প্রাসাদ বলে ভুল হতে পারে। তবে এই প্রাসাদ কোনও ঐতিহাসিক নয়, বরং এটি নির্মাণাধীন একটি ব্যক্তিগত অট্টালিকাযার মালিক, কার্বি আংলং স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের মুখ্য কার্যনির্বাহী সদস্য তুলিরাম রংহাং।
সম্প্রতি এই অট্টালিকার একাধিক ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তাতে দেখা যাচ্ছে এক বিশাল আয়তনের বিল্ডিং, যা নির্মাণশৈলীতে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের সঙ্গে তুলনীয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই অট্টালিকা নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।
ভাইরাল হওয়া ভিডিও এবং ছবিগুলি দেখে সাধারণ মানুষ বিস্মিত। রাজ্যের প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে, যেখানে বহু মানুষ এখনো মৌলিক পরিকাঠামোর অভাবে ভুগছেন, সেখানে একজন জনপ্রতিনিধির এত বিলাসবহুল গৃহনির্মাণ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
তুলিরাম রংহাং নামটি কার্বি আংলঙে অপরিচিত নয়। বিগত ১৩ বছর ধরে তিনি স্বায়ত্তশাসিত পরিষদের মুখ্য কার্যনির্বাহী সদস্য পদে রয়েছেন। কংগ্রেস সরকারের আমল থেকে শুরু করে বর্তমান বিজেপি শাসনে তিনিই কার্বি আংলঙের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত।
বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৌড় বর্তমানে শিখরে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই রয়েছে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ। কয়লার অবৈধ ব্যবসা, বালি ও পাথরের লুঠ, বনজ সম্পদের অপব্যবহার এই সমস্ত ক্ষেত্রেই স্থানীয়দের অভিযোগ, সবকিছুর পেছনে রয়েছেন তুলিরাম রংহাং ও তাঁর অনুগামী চক্র।
এই অট্টালিকা নির্মাণের কাজের বরাত পেয়েছে “এইচ.বি.এস” নামের অসমের বাইরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। চমকপ্রদ বিষয় হলো, এই সংস্থার কর্ণধার নিজেই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে তারা ১০০ কোটির বেশি টাকার বিনিময়ে এই কাজটি পেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য সামনে আসতেই এই প্রকল্পকে ঘিরে জেলাজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। বিরোধী দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে, এতবড় প্রকল্পে কীভাবে সরকারি অর্থ বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে? সাধারণ করদাতাদের টাকায় এই বিলাসিতার উৎস কোথায়?
সম্প্রতি কার্বি আংলং জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিদ্যাসিং রংপি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তুলিরাম রংহাং-এর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, কার্বি আংলঙে কয়লা, বালি, সাদা পাথর, সেগুন কাঠ, বনজ সম্পদ সবকিছুর লুঠ চলছে তুলিরামের আশীর্বাদেই। বনবিভাগ তাঁর নিয়ন্ত্রণে, অথচ তিনি কিছু জানেন না, এমন কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
রংপির অভিযোগ অনুযায়ী, এই অট্টালিকা হল সেই দুর্নীতির বাস্তব রূপ। কোটি কোটি টাকার সম্পদ যে কীভাবে একজন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত আয়ত্বে আসে, তার প্রতিচ্ছবি এই প্রাসাদসদৃশ বাড়ি। অসম বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলে এসেছেন।
কিন্তু দলেরই একজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে এত গুরুতর অভিযোগ উঠলেও এখনো পর্যন্ত সরকারপক্ষ থেকে কোনও তদন্ত বা ব্যাখ্যার কথা শোনা যায়নি। এতে রাজ্যের জনমানসে প্রশ্ন উঠেছে, এই কি তাহলে সেই জিরো টলারেন্স? ডিফুর এই বিতর্কিত প্রাসাদ এখন যেন অসমের রাজনীতির এক নতুন প্রতীক যেখানে ক্ষমতা ও প্রভাবের হাত ধরে দুর্নীতির স্থায়ী আসন গড়ে উঠেছে।
অসমের মানুষ চায় উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছ প্রশাসন। কিন্তু যেখানে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সেবার বদলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত, সেখানে গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা কোথায় দাঁড়িয়ে? ডিফুর এই অট্টালিকা শুধু একটি বিল্ডিং নয়, এটি দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও প্রশাসনিক ঔদ্ধত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এই অভিযোগগুলির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন কি না, নাকি এই বিতর্কও সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে আরও একটি ‘ভুলে যাওয়া ইস্যু’ হিসেবে?