
বরাকবাণী প্রতিবেদন গুয়াহাটি ২রা মেঃ অসমে বাংলাদেশি নাগরিক ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবৈধ অনুপ্রবেশ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রতিদিনই সীমান্ত এলাকায় বেআইনি প্রবেশের ঘটনা সামনে আসছে, এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও এ বিষয়ে সোচ্চার। সামাজিক মাধ্যমে ও সাংবাদিক বৈঠকে তিনি নিয়মিত রাজ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সীমান্তের অবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবগত করে চলেছেন।
সম্প্রতি শ্রীভূমি জেলার ভাঙ্গা রেলস্টেশনে ধরা পড়েছে এক রোহিঙ্গা যুবতীসহ তিনজন রোহিঙ্গা—জুবেইর, কাউসার ও উন্মাই সালিমা। গৌহাটিগামী ট্রেন ধরার অপেক্ষারত অবস্থায় তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সূত্র অনুযায়ী, তারা সকলেই বাংলাদেশে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘ নয় বছর বসবাস করার পর মানব পাচারকারীদের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করে।

এক পুলিশ উপ-পুলিশ অধীক্ষক পদমর্যাদার কর্মকর্তা জানান, ধৃতরা স্বীকার করেছে যে তারা কক্সবাজার শিবির থেকে পালিয়ে এসে পাহাড়ি পথ ব্যবহার করে অসম সীমান্তে প্রবেশ করেছে। পথে তারা একজন দালালকে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪,০০০ টাকা করে প্রদান করে। তাদের সঙ্গে ভাঙ্গা স্টেশনে আরও দুই দালাল থাকলেও তারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, কক্সবাজারে একটি সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্র রয়েছে যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশে সহায়তা করে। কেউ স্বেচ্ছায় আসছে, কেউ পাচার হচ্ছে। পুলিশের মতে, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, তদারকি সরকারের অনিশ্চয়তা এবং জীবিকার সংকট এই প্রবণতাকে আরও তীব্রতর করেছে।
এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে বাংলাদেশের কিছু ভারতবিরোধী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ভারতে ঢুকিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অস্থিতিশীল করতে চাইছে। অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ২৬৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১৯০ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও প্রায় ৭৩ কিলোমিটার অঞ্চল এখনো উন্মুক্ত। এই খোলা সীমান্তের বড় অংশ নদী ও দুর্গম ভূখণ্ড হওয়ায় বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি।

ধুবুরী ও দক্ষিণ শালমারা-মানকাচর অঞ্চলে ভূগোলগত কারণে কাঁটাতার সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে প্রশাসন। করিমগঞ্জ জেলায় আবার বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীদের আপত্তির কারণে প্রায় ৪.৩৫ কিলোমিটার এলাকায় বেড়া দেওয়া যায়নি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ৪০৯৬.৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মধ্যে এখনো ৮৬৪.৪৮২ কিলোমিটার এলাকা খোলা পড়ে আছে। এর মধ্যে ১৭৪.৫১৪ কিলোমিটার এমন ভূখণ্ডে অবস্থিত, যেখানে কাঁটাতার স্থাপন করা যায় না। এই এলাকাগুলি এখন জালনোট, গরু, মাদক ও সোনার চোরাচালানের জন্য ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি এক সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ভারতের জন্য একটি গভীর সমস্যা। অসম ও ত্রিপুরা এ বিষয়ে সতর্ক ও সক্রিয় হলেও পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের নীরবতা রীতিমতো আশঙ্কার বিষয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আশ্রয় দেওয়ার বক্তব্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করছে। এর খেসারত গোটা দেশকে দিতে হবে।
তিনি স্পষ্ট করে জানান, অসম সরকার সীমান্তে কড়া নজরদারি চালাচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছে। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির উদাসীনতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। বিএসএফ ও অন্যান্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী অসম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে নতুন নতুন অনুপ্রবেশপথের সন্ধান পেয়েছে। নদী অঞ্চলগুলোতে উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা বসানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে, পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চল দিয়ে রাতের অন্ধকারে অনুপ্রবেশকারীরা সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করছে।
অসম আজ এক বহুমাত্রিক সংকটের মুখোমুখি—বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ, রোহিঙ্গা ঢল, সীমান্তের ভৌগোলিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পাচারচক্রের সক্রিয়তা একযোগে রাজ্য ও দেশের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলিকে সমন্বিত, কঠোর এবং প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ নিতে হবে—তা না হলে অনুপ্রবেশ রোধের লড়াই ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে। এই সংকটের সমাধান শুধু কাঁটাতারের বেড়া নয়, বরং একটি সমন্বিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশলের প্রয়োগই পারে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে।