
বরাকবাণী প্রতিবেদন, শিলচর, ২১ জুলাই : কাছাড়ের জেলা আয়ুক্তের কার্যালয়ে অনিয়ম নতুন কোনও বিষয় নয়। কিছুদিন পর পরই বিভিন্ন অভিযোগ সামনে আসে। জেলা আয়ুক্তের নজরে বিষয়টি এলে কখনও ‘তদন্তের মাধ্যমে’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়ম লুকিয়ে রেখে একাংশ কর্মী যে ‘বাবু সিন্ডিকেট’ গড়ে তুলেছিলেন, আজও সেই সিন্ডিকেটের প্রভাব অব্যাহত।
বস্তুত, জেলা আয়ুক্ত একটি জেলার সর্বময় কর্তা হলেও প্রশাসনের ‘মধুভাণ্ড’ যার কাছে থাকে, তিনি হলেন নাজারত শাখার ‘বড়বাবু’ অর্থাৎ ‘নাজির’। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, কাছাড়েও বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ চালিয়ে যাচ্ছেন বিভাগীয় ‘বাবু’ তথা বর্তমান ‘নাজির’ প্রবীরকুমার কুর্মী।
জানা গেছে, কাছাড় জেলা প্রশাসনে শতাধিক কেরানি বা ‘বাবু’ কর্মরত হলেও শুধু প্রবীরকুমার কুর্মী তাঁর চাকরির পর থেকেই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমানে তিনি নাজারত শাখার বরিষ্ট করণিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ টেবিলের দায়িত্বে থাকলেও একই সঙ্গে তিনি নির্বাচন শাখাতেও একই টেবিল সামলাচ্ছেন। একই ব্যক্তি, দুটি পদে বা দুটি টেবিলের দায়িত্বে কীভাবে এবং কোন বিশেষ ক্ষমতায় থাকতে পারেন, সেটি জেলা প্রশাসনের কর্মী মহলেই বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, প্রবীরকুমার কুর্মী ‘নাজির’ হওয়ার সুবাদে জেলা আয়ুক্তের কার্যালয়ের গাড়ি সরবরাহের দায়িত্বও তাঁর হাতে ন্যস্ত। সূত্রের খবর, ট্যুর অপারেটর লাইসেন্স থাকা এবং টেন্ডারের মাধ্যমে কোনও সংস্থাকে বরাত না দিয়েই ব্যক্তিগতভাবে গাড়ি সরবরাহের কারবার চালাচ্ছেন প্রবীরবাবু। ডিসি এবং ডিডিসি ব্যতিরেকে সব অফিসারের গাড়ির বন্দোবস্ত তাঁকেই করতে হয়। এর বিনিময়ে গাড়ি ভাড়ার টাকাটা তিনিই নামে-বেনামে আদায় করছেন। কারণ, সেই টাকা মেটানোর দায়িত্বেও তো তিনিই রয়েছেন। একই ভাবে আবহমান কাল ধরে সেসব গাড়ি রিপিয়ারিং-এর দায়িত্বও সামলে যাচ্ছেন করিৎকর্মা এই বাবু।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ২০২১ সালে নির্বাচনের সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরাত পেয়ে কাজ করা লোকদেরও পকেট কাটছেন প্রবীরবাবু। জেলা আয়ুক্তের নির্বাচন শাখার ‘বাবু’ হওয়ার সুবাদে পেমেন্টের সময় সবার কাছ থেকে তিনি দিব্যি মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় করেছেন বলে অভিযোগ। বিভিন্ন অনিয়মের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক বার প্রশাসনের কাছে অনেকেই লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
কিন্তু ‘নাজির’ হওয়ার সুবাদে তিনি সেই অভিযোগনামা ফাইল থেকেই গায়েব করে দেন। ফলে বিষয়টি জেলা আয়ুক্তের নজরেই আসে না। এভাবেই হয়তো কাছাড়ের জেলা আয়ুক্তের কার্যালয়ে ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ কায়েম রেখেছেন ‘বাবু সিন্ডিকেট’-এর মাথা প্রবীরকুমার কুর্মী। আর বিভিন্ন ‘দায়িত্ব’ সামলাচ্ছেন বলেই হয়তো তাঁকে কোনও দিন বদলি করেনি জেলা প্রশাসন!
আসলে কাছাড় জেলা প্রশাসনে ‘সুশাসন’ ফিরিয়ে আনতে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন জেলাশাসক কীর্তি জাল্লি। ‘বাবু সিন্ডিকেটের’ জড় সমূলে উৎপাটন করার পদক্ষেপ শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথমে পদোন্নতি ও বদলির পুরনো আদেশ দু’দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করেছিলেন। রদবদল প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রাজস্ব শাখাতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। জেলাশাসক রোহনকুমার ঝা-র আমলেও ব্যাপক রদবদল হয়েছিল।
একযোগে মোট ৫৮ জন বরিষ্ঠ প্রশাসনিক সহকারীকে রদবদল করেন তিনি। ২০২২ সালের এই বদলি প্রক্রিয়ায় তালিকায় নাম ছিল, কিন্তু আদৌ ‘বদলি’ হননি, এমন অনেক কর্মীও অবলীলায় ‘রেহাই’ পেয়ে যান। মোট ১৯ জন এমন কর্মী ছিলেন, যাদের কাজের স্থান এবং বদলিকৃত স্থান একই থেকে যায়। এর মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন ‘প্রবল ক্ষমতাবান’। সেই ‘জি-১৮’-র অন্যতম ছিলেন নাজারতের প্রবীরকুমার কুর্মী।
অসম সরকারের প্রশাসনিক বিধি অনুযায়ী সরকারি কোনও কর্মচারী একই টেবিলে বা একই কার্যালয়ে তিন বছরের বেশি থাকতে পারেন না। তাঁকে বদলি করাই নিয়ম। কিন্তু জেলা প্রশাসনের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে বলে এভাবে একজন কর্মী স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়ম চালিয়ে গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে না কেউ। প্রবীরকুমার কুর্মী তিন বছরের বেশি সময় ধরে ‘নাজির’ পদেও কর্মরত। কিন্তু তাঁর বদলি নেই। জেলা প্রশাসনের সংস্কার কীর্তি জাল্লির আমলে শুরু হয়ে, রোহনকুমার ঝা পেরিয়ে এখন মৃদুলকুমার যাদবের হাতে রয়েছে। অতীতে বার বার ‘রেহাই’ পেয়ে আসা প্রবীরকুমার কুর্মীকে এবার আইনের জালে বন্দি করা যাবে বলে আশাবাদী সচেতন মহল।