
বরাকবাণী প্রতিবেদন লক্ষীপুর, ১৩ জুলাইঃ একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে লক্ষীপুরে শুরু হয়েছে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। আইন কলেজ, সতসজ্জা বিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল, মহকুমা শাসকের কার্যালয়, মডেল ডিগ্রি কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক উন্নয়ন সহ বহু প্রকল্প ইতোমধ্যেই চলমান। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় শো শো কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই প্রকল্পগুলির বেশিরভাগই সূচনা করেছিলেন লক্ষীপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী কৌশিক রাই ।
প্রতিটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, এই প্রকল্পগুলি জনহিতার্থে সরকার বরাদ্দ করেছে। কাজ ভালোভাবে হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে স্থানীয়দের নজর রাখতে হবে। কোনো গাফিলতি দেখা দিলে সরব হোন, প্রয়োজনে আমাকে জানান, ব্যবস্থা নেব। এ প্রশ্নে জনসাধারণের বক্তব্য, আমাদের হয়ে তো কথা বলার জন্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো ছিল।

এখন লক্ষীপুরে সে দৃশ্য প্রায় উধাও হয়ে গেছে। জনসাধারণের অভিযোগ, বর্তমানে লক্ষীপুরে কার্যত বিরোধী রাজনীতি নেই। একসময় বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায় সরব হয়ে উঠতো দল ও সংগঠনগুলি। কিন্তু আজ তারা নিশ্চুপ। এর পেছনে বিজেপির কৌশলগত পরিকল্পনার কথাও বলছেন অনেকে।
লক্ষীপুরবাসীর অভিযোগ, বিজেপি প্রথমবারের মতো কৌশিক রাইকে বিধায়ক করে এনেছিল আশার আলো দেখিয়ে। প্রথমদিকে কিছুটা সক্রিয়তা থাকলেও সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় চিত্র। দলের পুরনো কর্মীদের ব্রাত্য করে, প্রতিপক্ষ থেকে লোক এনে দলে জায়গা দেওয়া হয়। সামাজিক সংগঠনগুলোও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রভাবে খুঁইয়ে বসে।
ফলে এখন লক্ষীপুরে নেই কোনো সক্রিয় বিরোধী দল বা সংগঠন, যারা কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে নজরদারি করতে পারে বা প্রতিবাদে সরব হতে পারে। লক্ষীপুর শহরের একাধিক এলাকায় বর্তমানে চলছে বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্প। সবচেয়ে আলোচিত ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থায়নে ১২৭ কোটি টাকার সুসজ্জিত হাসপাতাল নির্মাণ। স্থানীয়দের একাংশ বলছেন, নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের বালু ও অন্যান্য সামগ্রী।
কিন্তু এই অভিযোগের প্রমাণ সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ ভিতরে ঢোকা মানেই হয়রানি, নজরদারি রুদ্ধ! সাধারণ নাগরিক, এমনকি সংবাদকর্মীরাও নির্মাণস্থলে প্রবেশ করতে গেলে পড়ছেন জটিল নিয়মের মুখে। বাউন্ডারি ঘেরা জায়গায় প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই পাহারাদারের অনুমতি নিতে হয়। তারা ঠিকাদারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে সবুজ সংকেত পেলে তবেই অনুমতি দেন।
এরপর অতিথিকে রেজিস্টারে স্বাক্ষর করতে হয়। ভিতরে থেকে বের হওয়ার সময়েও আবার স্বাক্ষর করতে হয়। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে একধরনের ভীতি, অনিচ্ছা এবং অহেতুক হয়রানি। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যদি নির্মাণ কাজ স্বচ্ছভাবে হয়ে থাকে, তাহলে এত কঠোর প্রবেশনীয় নিয়ম কেন? জনগণের টাকায় যখন এসব কাজ হচ্ছে, তখন জনগণ কি তা দেখার অধিকার রাখে না?
লক্ষীপুরের চিরিপুল এলাকায় আইন কলেজ নির্মাণ কাজ নিয়েও একই ধরনের অভিযোগ। স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণভাবে দেখতে গেলেও সিকিউরিটির অনুমতি নিতে হয়। ভিতরে কী হচ্ছে, কেমন সামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে, জানতে পারাটাই এখন চ্যালেঞ্জ। মন্ত্রী কৌশিক রাই বর্তমানে রাজ্যস্তরে দায়িত্বে ব্যস্ত। ফলে স্থানীয় নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্ব পড়েছে ঠিকাদারদের ওপর।
বস্তুত, এখন প্রকল্পগুলি চলছে ঠিকাদার-মুখাপেক্ষী মডেলে। এই অবস্থায় নির্মাণ শেষ হওয়ার পর কোনো গাফিলতি বা দুর্নীতি ধরা পড়লেও, দায় চাপানোর লোক পাওয়া যাবে না, এমন আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল। জনগণের বক্তব্য, সরকারি অর্থে চলা এই সব কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা অনিয়ম রোধের দায়িত্ব যাদের ছিল, তারা এখন দৃশ্যপটেই নেই। এর সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার কর্মী বলেন, অভ্যন্তরীণ কিছু চাপ থাকে। বাইরে থেকে কেউ ঢুকলেই নির্মাণকার্যের ফুটেজ বাইরে গেলে সমস্যা হয়। এমন অবস্থায় লক্ষীপুরে শুরু হওয়া কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভবিষ্যতে জনগণের আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।