
বরাকবাণী প্রতিবেদন, গুয়াহাটি, ১৩ জুলাই: অসমের বন্যা এবং ভাঙন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন দল-সংগঠন বন্যা এবং নদী ভাঙনকে জাতীয় সমস্যারূপে গণ্য করে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য দাবি জানিয়ে এলেও কেন্দ্রের প্রতিটি সরকার নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। পূর্বের কংগ্রেস সরকারের মতো বর্তমান ডাবল ইঞ্জিন বিজেপি সরকারও এই সমস্যার সমাধানের জন্য আজ পর্যন্ত বিশেষ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। নির্বাচনের সময় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বন্যামুক্ত অসমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অসম সফরে গুয়াহাটিতে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এক বৈঠক করেছিলেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথাও ঘোষণা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণার জন্য আরও ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এর পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বন্যামুক্ত অসম ঘোষণা করেন। কিন্তু সব ঘোষণা-প্রতিশ্রুতি বাস্তবে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে।
রাজ্যের বরাক-ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদীগুলির ভয়াবহ নদী ভাঙনে ইতিমধ্যে কয়েক লক্ষ লোককে সর্বহারা করে ফেলেছে। বন্যা এবং ভাঙনের জন্য ভূমিহীন-গৃহহীন লোকদের অনেকের কাছে নদীবাঁধই আজ স্থায়ী বাসস্থান। অসমের জন্য অভিশাপস্বরূপ বন্যা এবং ভাঙন প্রতি বছরই ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আসছে। এক কথায়, বন্যা এবং ভাঙনে অসমের মানচিত্রই আজ পরিবর্তন করে ফেলেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বহু ঐতিহাসিক স্থানের ঠিকানা।

ভাঙনগ্রস্তরা অসহায়ভাবে শুধু প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের স্বপ্নের বাড়ি, নিজের কৃষি জমি, ধর্মীয় স্থল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীর বুকে তলিয়ে যাওয়ার অসহনীয় দৃশ্য। ইতিমধ্যে নদী ভাঙনে রাজ্যের চারশোর বেশি গ্রাম অসমের মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। দিসপুর জনতা ভবনস্থিত অসম রাজ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে বন্যা এবং ভাঙনের ফলে প্রবল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে ৯০০টিরও বেশি গ্রাম। নদী ভাঙনে এই গ্রামগুলির বাসিন্দাদের আতঙ্কিত করে রেখেছে। ব্রহ্মপুত্র-বরাক এবং এর উপনদীগুলির ভাঙনের তীব্রতা যে কোনও মুহূর্তে এই গ্রামগুলির চিহ্ন নষ্ট করে দিতে পারে, এই আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা। যে কোনও মুহূর্তে এই গ্রামগুলি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
রাজ্যের বেশ কিছু জেলার ৯৭২টি গ্রাম আংশিকভাবে ইতিমধ্যে নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে ধুবড়ি জেলা। জেলার ১৫১টি গ্রাম ভাঙনের দ্বারা প্রভাবিত। রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক ভাঙনের তীব্রতা রয়েছে জেলার আটানি রাজস্ব চক্রে। সেখানকার ৫৫টি গ্রাম ইতিমধ্যে ভাঙনের কবলে পড়েছে। উদ্বেগের বিষয় হল, নদীর বুকে ইতিমধ্যে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বিঘা জমি তলিয়ে গেছে।
ভাঙনের এই ভয়াবহতা চলতে থাকলেও কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের এতে কোনও গুরুত্বই নেই। সরকারের অবহেলার জন্যই রাজ্যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করা ভাঙন ইতিমধ্যে বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে। বর্তমানে রাজ্যের ৭০টি রাজস্ব চক্রের অন্তর্গত ৯৭২টি গ্রামের বাসিন্দাদের বন্যার আতঙ্কে ভুগতে হচ্ছে। ২৩টি জেলার জেলা কমিশনারদের এই উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়ার পরও কেন্দ্রীয় সরকার এখনও রাজ্যের বন্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করেনি।
স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রের সব সরকারই অসমের এই জ্বলন্ত সমস্যাটিকে গুরুত্বহীন করে আসছে। কিন্তু নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো অসমের বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ভোটপর্ব চুকে গেলেই সরকার সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে যায়। জানা গেছে, বন্যায় ধুবড়ি জেলার ১৫৯টি গ্রাম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে বহু গ্রামের অধিকাংশ ভূমি, সম্পত্তি, সরকারি প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ইতিমধ্যে নদী গর্ভে চলে গেছে। ধুবড়ি জেলার বিলাসীপাড়া, চাপর, ধুবড়ি, গোলকগঞ্জ, আগমনি, দক্ষিণ শালমারা রাজস্ব চক্রের বিভিন্ন গ্রাম বন্যায় আংশিকভাবে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বহু পরিবার বসত-বাড়ি হারাতে বাধ্য হয়েছে।
একইভাবে বরপেটা জেলার রাজস্ব চক্র হিসেবে বরপেটার ৯টি, বাঘবরের ৩৫টি, বরনগরের ১৫টি, চেঙার ৩১টি, কলাইগাঁওয়ের ১৬টি এবং সৰ্থেবাড়ির ৫টি সহ শতাধিক গ্রাম বন্যার কবলে পড়েছে। গোলাঘাট জেলার দেড়গাঁও, বোকাখাত, মোরঙ্গী এবং সরুপথার রাজস্ব চক্রের অর্ধশতাধিক গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। কামরূপ গ্রামীণ জেলার পলাশবাড়ি সহ ১৩টি গ্রাম, রঙিয়া, ছমরিয়া, নগরবেরা রাজস্ব চক্রের ২০টি গ্রাম ভাঙন প্রভাবিত বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, নগাঁও জেলার ধিং, রূপহি, সামাগুড়ি, কলিয়াবর এবং রহা রাজস্ব চক্রের অধীনে ৪০টি গ্রাম ভাঙনের দ্বারা প্রভাবিত। তেজপুর জেলার নদুয়ার রাজস্ব চক্রের সর্বাধিক ১২টি গ্রাম সহ ঢেকিয়াজুলি, ঠেলামারা, তেজপুর, চারিদুয়ার রাজস্ব চক্রের ৩৩টি গ্রাম নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। এছাড়া দক্ষিণ শালমারা-মানকাচর জেলার ২৪টি গ্রাম এবং হোজাই জেলার ৩টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। দরং জেলার ৩৭টি গ্রাম এবং মরিগাঁও জেলার ৩২টি গ্রাম ভাঙনের শিকার।
এদিকে, বঙাইগাঁও জেলার সৃজনগ্রাম, মাণিকপুর এবং বৈঠামারি রাজস্ব চক্রের অন্তর্গত অর্ধশতাধিক গ্রাম নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উত্তর লখিমপুর রাজস্ব চক্রের ২৫টি গ্রাম সহ জেলার কদম, সুবণসিড়ি, ঢকুয়াখানা এবং নারায়ণপুর রাজস্ব চক্রের ৪৮টি গ্রামে নদীর ভাঙন বিপদঘণ্টা বাজিয়েছে। ধেমাজি জেলার সিসিবরগাঁও এবং গোগামুখ রাজস্ব চক্রের অন্তর্গত ২৩টি গ্রামও ভাঙনের কবলে পড়েছে। তিনসুকিয়া জেলার তিনসুকিয়া, ডুমডুমা, মাৰ্ঘেরিটা এবং সদিয়া রাজস্ব চক্রের ৪৪টি গ্রাম ভাঙনের গ্রাসে পড়েছে।
সেভাবে মাজুলি জেলার ১১টি গ্রাম, চরাইদেউ জেলার ২টি গ্রাম, শিবসাগর জেলার ১৮টি গ্রাম ভাঙনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। গোয়ালপাড়া জেলার বালিজানা এবং লক্ষীপুর রাজস্ব চক্ৰের অন্তর্গত ৮৫টি গ্রামে এখন ভাঙনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। একইভাবে নলবাড়ি জেলার বরক্ষেত্রী রাজস্ব চক্ৰের অন্তর্গত ৪২টি গ্রাম নদীর গ্রাসে পড়েছে।
অন্যদিকে, বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর রাজস্ব চক্ৰের অন্তর্গত ৯টি গ্রাম এবং হাইলাকান্দি জেলার লালা রাজস্ব চক্ৰের অন্তর্গত ৩১টি গ্রাম আংশিকভাবে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে কাছাড় জেলার শিলচরের ৩টি, লক্ষীপুরের ১২টি, কাটিগড়ার ৩২টি এবং সোনাই রাজস্ব চক্ৰের ১২টি সহ অর্ধশতাধিক গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে।
বরাক এবং এর উপনদীগুলির ভাঙনের জন্য উপত্যকার ৯৭টি গ্রামে ইতিমধ্যে সংকট নেমে এসেছে। রাজ্যের ২৩টি জেলার মোট ৭০টি রাজস্ব চক্ৰের অন্তর্গত ৯৭২টি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়ায় জনগণের নিদ্রাহরণ হয়েছে। সময় থাকতে সরকার যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তবে নদী ভাঙনের কবলে পড়া এই গ্রামগুলো রাজ্যের মানচিত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
জানা গেছে, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭২, ১৯৮৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৪, ২০১২ সালের প্রলয়ংকরী বন্যাগুলোর পর বরাক-ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদীসমূহের ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শুধু তা-ই নয়, প্রতি বছর বন্যা রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে চলেছে এবং পাশাপাশি ভাঙনও উর্বর ভূমির সঙ্গে গ্রামগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে। বস্তুত, এভাবে নদীর গর্ভে একের পর এক গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার পরিণতিতে রাজ্যের কয়েকটি জেলার বহু গ্রাম পঞ্চায়েত অস্তিত্বহীন হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন পঞ্চায়েতের বহু লোক বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ভাবে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বহু লোক এখন ব্রহ্মপুত্রের কয়েকটি চরের স্থায়ী বাসিন্দা। বন্যা এবং ভাঙনে সর্বহারা হয়ে পড়া লোকদের বৃহৎ সংখ্যক এখন সরকারি ভূমিতে বসতি স্থাপন করে উচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু সরকারের সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।