
বরাকবাণী প্রতিবেদন কাটিগড়া, ১৩ জুলাইঃ কাছাড় জেলার কাটিগড়া চৌরঙ্গীতে অবস্থিত ব্যক্তি মালিকানাধীন সেন্ট্রেল হস্পিটেল যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসার নামে চরম গাফিলতির বলি এবার প্রসূতি রমজানা খাতুন। মৃত রমজানার পরিবার ও স্থানীয় জনতার ক্ষোভ-এই মৃত্যুর পিছনে রয়েছে পরিকল্পিত চিকিৎসা অবহেলা, আর একাংশের মতে, এটি একটি মেডিকেল ক্রাইম, যার মূল অভিযুক্ত এখনো প্রশাসনের নাগালের বাইরে।
প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনরোষ ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয় যে হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ, শিলনিক্ষেপ, এমনকি পুলিশের হস্তক্ষেপে লাঠিচার্জ পর্যন্ত করতে হয়। কিন্তু এই উত্তেজনার মাঝেই উঠে আসে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য—অভিযোগ, সেন্ট্রেল হস্পিটেলের সঙ্গে কয়েকজন সরকারি চিকিৎসকের আঁতাত রয়েছে। যার ফলে তদন্তে শুরু থেকেই অনিচ্ছা, অসহযোগিতা ও গড়িমসি দেখা যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের তরফে সার্কেল ম্যাজিস্ট্রেট ড. রবার্ট টেলোর নির্দেশে যখন তদন্তকারী দল হাসপাতাল পরিদর্শনে যায়, তখন কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ গরহাজির। এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্ম সঞ্চালক শিবানন্দ রায়ের নেতৃত্বে যখন দলটি পুনরায় হাজির হয় শনিবার সন্ধ্যাবেলায়, তখনও হাসপাতালের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ সামনে আসেননি। এর আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আগাম জানানো হলেও তাদের এই অদ্ভুত নিস্পৃহতা তদন্তকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। এই ঘটনায় কাটিগড়া মডেল হাসপাতালের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. জি. বি. দেউরি, সেন্ট্রেল হস্পিটেলের আরএমও ডা. তাসনিম সুলতানা লস্কর এবং হাসপাতালের আরও দুই কর্মীকে আটক করে জোর জিজ্ঞাসাবাদ করছে কাটিগড়া থানা। জিজ্ঞাসাবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাছাড় পুলিশের ডিএসপি মহেন্দ্র বরার স্বয়ং।
তবে যিনি এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী বলে পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ—ডা. সপ্তর্ষী চক্রবর্তী, তিনি এখনো প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশ্ন উঠছে, একজন অভিযুক্ত চিকিৎসক দিনের পর দিন কীভাবে পালিয়ে থাকতে পারে, আর কীভাবেই বা প্রশাসন তাকে খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয়? সেন্ট্রেল হস্পিটেল নামের এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে দিনের পর দিন চিকিৎসা নামে একের পর এক গাফিলতি চালিয়ে যাচ্ছে, তাও চিকিৎসকবিহীন অস্ত্রোপচারের মতো গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও, তা তদন্তসাপেক্ষ।
স্থানীয়রা দাবি করছেন, এই হাসপাতাল একটা ব্যবসা কেন্দ্র, জীবন বাঁচানো নয়, মুনাফা কামানোই ওদের আসল লক্ষ্য। একাংশ বলছে, একজন প্রসূতিকে চিকিৎসক ছাড়াই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়—এটাই যদি সত্যি হয়, তবে সেটা খুনের শামিল। আর যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা খুনি। শুধু হাসপাতাল সিল করে দিলেই হবে না, এই প্রতিষ্ঠান চালানোর লাইসেন্স কে দিল, কীভাবে সরকারি চিকিৎসকরা এখানেও কাজ করছিলেন—সবটা খতিয়ে দেখা উচিত।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সার্কেল ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ডাক উপেক্ষা করেও যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন এটা শুধুই উদাসীনতা নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যর্থতার নগ্ন উদাহরণ। শনিবার, এক হৃদয়বিদারক পরিবেশে, কফিনবন্দি রমজানার দেহ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়।
পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলেই একটাই প্রশ্ন তুলছে—এ মৃত্যু কি ন্যায়বিচার পাবে? নাকি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় চাপা পড়ে যাবে আরও এক গর্ভবতী নারীর জীবন ও সম্ভাবনা? জনগণ এখন কেবল একটাই দাবি জানাচ্ছে—এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিচার হোক, এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে যেন ভবিষ্যতের কোনও রমজানাকে সেন্ট্রেল হস্পিটেলের মতো মৃত্যু-ঘরে প্রাণ হারাতে না হয়।