শিক্ষার আড়ালে চলছে সেন্ডিকেট রাজ! কালাইন ও কাটিগড়া সহ কাছাড় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভুয়ো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রমরমা ব্যবসা

এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে একেবারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। পড়ানো হচ্ছে নবম ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের, অথচ নেই কোনো বৈধ অনুমোদন। অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে ভাড়াবাড়িতে যা পরিষ্কারভাবে আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশনার লঙ্ঘন। ২০২৪ ও ২০২৫ সালে অসম উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পরিষদ (AHSEC) একাধিক নির্দেশনা জারি করে জানিয়ে দেয়—নন-পারমিটেড ও নন-অ্যাফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠানগুলো নবম ও একাদশ শ্রেণিতে ছাত্র ভর্তি করাতে পারবে না। বিশেষভাবে বলা হয়, ভাড়াবাড়িতে পরিচালিত হলে এই নিয়ম আরও কঠোরভাবে প্রযোজ্য হবে।

তবে বাস্তবচিত্র হলো, এই নির্দেশনাগুলো কেবল ফাইলের পাতায়। মাঠপর্যায়ে এর প্রয়োগ বলতে গেলে শূন্য। কাঠগড়া ও কালাইনে একাধিক প্রতিষ্ঠান এই নির্দেশনার নির্লজ্জ উপেক্ষা করে আজও দিব্যি চালাচ্ছে ক্লাস, নিচ্ছে ভর্তি, এমনকি নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি রেজিস্ট্রেশনও করিয়ে নিচ্ছে। ২০২৪ সালের ৪ঠা জুলাই জারি করা এক নির্দেশনায় শিক্ষা বিভাগ স্পষ্ট জানায়—নন-পারমিটেড প্রতিষ্ঠানে পড়া ছাত্রদের ‘ফেইক স্টুডেন্ট’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই নির্দেশনা অনুযায়ী আজ পর্যন্ত কতজন শিক্ষার্থীকে ফেইক স্টুডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে? কতটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? উত্তর জানা নেই কারো। জেলা শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে নেই কোনো স্বচ্ছতা, নেই কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ।

বিশেষ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে শিক্ষাজগতে। জানা গেছে, কালাইন-কাটিগড়া সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক অনুমোদনহীন তথা ভুয়ো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। অথচ পুলিশ প্রশাসন হোক কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আধিকারিক—কারোই যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।  অসংখ্য এমন প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সক্রিয়, যারা কোনও প্রকার সরকারি স্বীকৃতি বা অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এই সব প্রতিষ্ঠান। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলির নীরবতা এক রহস্যের জন্ম দিচ্ছে। প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তা কি নিছক অবহেলা, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো অসাধু যোগসাজশ? জনগণের কণ্ঠে প্রশ্ন—এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান কি প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলছে? কেন নেই কোনও কড়া পদক্ষেপ? কেন এতদিনেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি? স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিক্ষার নামে প্রতারণা চলছে খোলাখুলি, কিন্তু প্রশাসনের ভূমিকায় শুধুই চুপচাপ দর্শক।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নীরবতা একপ্রকার মদতের নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিক বার অভিযোগ উঠলেও এখনও পর্যন্ত কোনও বড়সড় পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। প্রশাসনের এই উদাসীনতা শুধু দুঃখজনকই নয়, লজ্জাজনকও বটে।

কালাইন ও কাঠিগড়া অঞ্চলজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার নামে এক প্রকার প্রতারণা চলছে, যার শিকার হচ্ছে অসংখ্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থী। প্রশাসনের নাকের ডগায় গড়ে উঠেছে একের পর এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যাদের নেই কোনো সরকারি অনুমোদন, নেই শিক্ষা দপ্তরের স্বীকৃতি। বিশেষ করে কাঠিগড়া ও কালাইনের কয়েকটি স্কুল—গোল্ডেন ভ্যালি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, অ্যাভিয়েটর সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, অ্যাক্সিস গ্লোবাল সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল, উইজডম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল—বিনাদ্বিধায় চলছে বছর বছর ধরে।

অথচ প্রশাসনের তরফে নেই কোনো পদক্ষেপ, নেই নজরদারি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এইসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ভর্তি নিচ্ছে এবং পরীক্ষা নিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। শুধু এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই নয়, কালাইন ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে আছে আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যাদের নেই কোনো বৈধ রেজিস্ট্রেশন, নেই কোনো মানসম্পন্ন শিক্ষা কাঠামো। অথচ এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের নৈরাজ্য ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকি। শিক্ষার্থীরা যেখানে ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে স্কুলে যায়, সেখানে এইসব ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান তাদের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে। পাসের পর উচ্চশিক্ষায় কিংবা চাকরির সময় এইসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সনদের কোনো মূল্যই থাকে না। প্রশাসনের নিরবতা এবং শিক্ষা দপ্তরের গাফিলতি নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা চরমে। একাধিক অভিভাবক দাবি করছেন, যদি এগুলো অবৈধ হয়, তাহলে এতদিন ধরে প্রশাসন কি করছিল? এখন আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যত কি হবে?

উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের ২৪শে মার্চ জেলা শিক্ষা পরিদর্শকের এক নির্দেশনায় কঠোরভাবে জানানো হয়—নন-পারমিটেড প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই ছাত্রদের অনুমোদিত বিদ্যালয়ের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করাতে পারবে না। করলে, সংশ্লিষ্ট অনুমোদিত বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন বাতিল সহ ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কোথায়? এমন স্পষ্ট নির্দেশনার পরও কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজও নির্বিঘ্নে চলছে? কে বা কারা দিচ্ছে এই সাহস?

জনমনে প্রশ্ন, এইসব বেআইনি কার্যক্রম কি প্রশাসনের নাকের ডগায় ম্যানেজমেন্টের ফর্মুলা মেনে চলছে? এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ উঠেছে, কিছু সরকারি স্কুলের শিক্ষক নিজের বেতন তো নিচ্ছেন সরকার থেকে, অথচ কার্যত যুক্ত হয়ে পড়েছেন এইসব বেআইনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দিনে সরকারি স্কুল, আর বিকেলে বা অন্যসময়ে গোপনে পড়ানো, ম্যানেজমেন্ট দেখা এসব যেন এক ‘ওপেন সিক্রেট’।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ অভিভাবক ও শিক্ষার্থী। আজ অভিভাবকরা চিন্তিত—এইসব বেআইনি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সন্তানদের ভবিষ্যৎ কোথায়? রেজিস্ট্রেশন বাতিল হলে তাদের কি হবে? সরকারি চাকরি বা উচ্চ শিক্ষার সময় এই রেজিস্ট্রেশন কি বৈধ বলে গণ্য হবে? অথচ তারা যে প্রতারিত হচ্ছেন, সেটাই তারা বুঝতে পারছেন না—কারণ এই চক্র অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন, ভুলভাল কাগজপত্র, আর মিথ্যা আশ্বাস দেখিয়ে অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে চলেছে।

Related Posts

শাসক দলের চাঁদাবাজ কয়লা, সুপারি চুন পাথর, সহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের রাজত্বে বরাক অশান্তির পথে: গৌরব গগৈর গুরুতর অভিযোগ

বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ৬ জুন: আসামের বন্যা বিধ্বস্ত বরাক উপত্যকা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আর সরকারি ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত নিদর্শনে। সফরের দ্বিতীয় দিনে আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি তথা…

ঈদের প্রাক্কালে অবৈধ গরুর বাজারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গো-রক্ষা বিভাগ

বরাকবাণী প্রতিবেদন,পাথারকান্দি,৬ জুন:  ঈদের প্রাক্কালে শ্রীভূমি জেলায় অবৈধ গরুর বাজার বন্ধের দাবিতে শ্রীভূমি জেলা আয়ুক্তের মারফৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রেরণ তথা রাজ্যের মীন,পশুপালন ও পূর্ত দফতরের মন্ত্রী  কৃষ্ণেন্দু পালের হাতে…