
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর ৮ মেঃ ধলাই হয়ে বরাক উপত্যকায় ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ইউরিয়া সারের কালোবাজারি। ধলাই যেন ধীরে ধীরে অবৈধ সামগ্রীর রমরমা ব্যবসায়ের আঁতুড়ঘরে পরিণত হচ্ছে। ড্রাগস্, হিরোইন, অবৈধ বিদেশি সিগারেট, মদ, এমনকি ডাকাতি—একটার পর একটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে উঠছে এই সীমান্তবর্তী এলাকা। এই তালিকায় এবার নাম লেখাল ইউরিয়া সারের পাচারচক্র।
প্রশাসনিক গাফিলতি ও সিন্ডিকেট চক্রের যোগসাজশে কোটি টাকার সরকারি সার পাচার হচ্ছে পাহাড়ি রাজ্য মিজোরাম হয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে মায়ানমারে। গত সোমবার গভীর রাতে গোপন সূত্রের ভিত্তিতে কাছাড় সদর থানার একটি বিশেষ পুলিশ দল অভিযান চালিয়ে ধলাই থেকে দুটি ইউরিয়া ভর্তি ট্রাক আটক করে। ট্রাক দু’টি যাচ্ছিল মিজোরামের দিকে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধার করা হয়েছে ৩৫০ বস্তা ইউরিয়া সার, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ লক্ষ টাকা। আটক করা হয়েছে দুই ট্রাক চালককে।
সোমবার সকালে শিলচর-আইজল ৩০৬ নং জাতীয় সড়কের কাবুগঞ্জ এলাকায় এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পুলিশের জালে ধরা পড়ল ইউরিয়া সার পাচারের বড়সড় চালান। এএস-১১ সিসি-৭৮৪৪ নম্বরের একটি ট্রাক তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ উদ্ধার করে ৩৫০ বস্তা ইউরিয়া সার। জব্দকৃত প্রতিটি বস্তায় ছিল ৪৫ কেজি করে সার। অর্থাৎ, মোট ১৫ কুইন্টাল ৭৫০ কেজি ইউরিয়া সার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
এই ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় দুই ব্যক্তিকে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন সোনাবাড়িঘাট এলাকার বাসিন্দা, মাতাবুর রহমান মজুমদারের পুত্র ৪১ বছর বয়সী হোসেন আহমেদ মজুমদার এবং ধলাই থানার অন্তর্গত খুলিছড়া গ্রামের আসাব উদ্দিন লস্করের পুত্র ২২ বছর বয়সী ট্রাকচালক আনোয়ারুল হক লস্কর।
সূত্রের খবর, এই সারগুলি অবৈধভাবে বরাক উপত্যকার কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পাচারের উদ্দেশ্যে মিজোরাম হয়ে মায়ানমার পাঠানো হচ্ছিল। পাচারচক্রের পেছনে রয়েছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে সোনাবাড়িঘাট এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। জানা গেছে, জব্দ হওয়া ট্রাক দু’টি কুতুবুদ্দিন ও কবীর উদ্দিন নামের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন।
এই ঘটনার পর কাছাড় পুলিশ দ্রুত তৎপর হয়ে একটি মামলা নথিভুক্ত করেছে এবং তদন্তে নেমেছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাচারচক্রের আরও তথ্য উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই ঘটনার সূত্র ধরে বড়সড় একটি সার পাচার চক্রের জাল ভাঙার পথে রয়েছে তারা।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, বরাক উপত্যকার কৃষকদের প্রাপ্য ভর্তুকিযুক্ত ইউরিয়া সার কীভাবে কালোবাজারি হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে রাজ্যের বাইরের দিকে, যার ফলে স্থানীয় কৃষকরা বারবার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। পুলিশ তদন্তে নতুন কী তথ্য উঠে আসে, সেদিকে এখন তাকিয়ে গোটা বরাক উপত্যকা।
উল্লেখ্য, ধলাই বহুদিন ধরেই নানা অবৈধ কারবারের গোপন করিডোর হিসেবে পরিচিত। নেশাজাত দ্রব্য, অবৈধ বিদেশি সিগারেট, মদ, এমনকি অস্ত্রের পাচার–একাধিক অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে এই অঞ্চল। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল ইউরিয়া সারের কালোবাজারি। স্থানীয় কৃষকদের নামে সরকারি ভর্তুকির ইউরিয়া সার বরাদ্দ হলেও, বাস্তবে সেই সার অনেক সময় কৃষকের কাছে পৌঁছচ্ছে না। বরং, প্রশাসনিক তদারকির অভাবে ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় সেই সারের এক বড় অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল ও প্রতিবেশী দেশে। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, এই ধরনের অপারেশন কোনও ছোটখাটো চক্র দ্বারা নয়, বরং একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট চালাচ্ছে।
যারা প্রশাসনের কিছু অংশের সঙ্গে মিলে পরিকল্পিতভাবে এই বিপুল পরিমাণ পাচার সংগঠিত করছে। এক সিনিয়র পুলিশ অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই পাচার শুধু চালকদের দ্বারা সম্ভব নয়। ট্রাক কোথা থেকে লোড হচ্ছে, কে ছাড়পত্র দিচ্ছে, সবকিছুর পেছনে সুপরিকল্পিত নেটওয়ার্ক কাজ করছে। বিভাগীয় আধিকারিকদের ভূমিকাও তদন্তের আওতায় আসছে।
একসময় প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপে বরাকে ইউরিয়া পাচার কার্যত বন্ধ হয়েছিল। তবে গত কিছু মাস ধরে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট চক্র। বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে কারণ বারংবার এমন ঘটনা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এই ঘটনায় বরাক উপত্যকার সাধারণ কৃষক সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। স্থানীয় এক কৃষক বলেন, আমাদের নামে সরকার সার পাঠালেও আমরা তা পাই না। অথচ এই সার পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরে। এতে আমরা মার খাচ্ছি, আমাদের ফসল মার খাচ্ছে। অন্য এক সমাজকর্মী বলেন, যতদিন না প্রশাসন নিজেই নিজের ভেতরের দোষ ঢেকে রাখবে, ততদিন এই সিন্ডিকেট চলবেই।
আমরা চাই এই চক্রের মূল পান্ডাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে—কে বা কারা এই পাচারের মূল মাষ্টার মাইন্ড? সরকারি অফিসাররা কি তাদের দায়িত্ব পালন করছেন? কৃষি বিভাগের আধিকারিক ও কর্মী এবং সংশ্লিষ্ট ডিলারদের ভূমিকাও এখন তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশ আধিকারিক জানান, আমরা ঘটনার তদন্ত করছি এবং দ্রুত আরও গ্রেফতার হতে পারে। প্রয়োজন হলে বিভাগের আধিকারিকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পাচার রুখতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।