
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ১৫ এপ্রিলঃ শিলচরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা শিলংপট্টিতে অবস্থিত বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ‘চৌধুরী আই ক্লিনিক’-এ সোমবার সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া এক লজ্জাজনক ঘটনা সাধারণ মানুষের বিবেককে কাঁপিয়ে তুলেছে। মাত্র ২ বছর ৩ মাস বয়সী শিশুর উপর একজন চিকিৎসকের হাতে যে ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু চিকিৎসক নৈতিকতার পরিপন্থী নয়, বরং এক চরম অমানবিক, বর্বর ও আইনবিরোধী আচরণের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বইছে গোটা উপত্যকায়।
সোমবার সন্ধ্যায় প্রায় ৬:৩০ টার সময়, শিলচর শহরের বাসিন্দা সঙ্গীতা সাহা ও তাঁর স্বামী শভদ্বীপ ধর তাঁদের ২ বছর ৩ মাস বয়সী শিশুকন্যার চোখে সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যান চৌধুরী আই ক্লিনিকে। রোগ নির্ণয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. হৈমন্তী চৌধুরী তাঁদেরকে ডেকে নেন তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে। কিন্তু সেখানে শিশুর বাবা বা পরিবারের অন্য কেউ যাতে প্রবেশ না করেন, সে ব্যাপারে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন চিকিৎসক স্বয়ং।
চেম্বারের ভিতরে শিশুটির চোখ পরীক্ষা করতে গিয়ে চিকিৎসক কয়েকবার তাঁর হাত সরিয়ে দেওয়ায়, ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ডা. হৈমন্তী চৌধুরী। এরপর তিনি শিশু রোগীটির গালে একের পর এক চড় কষাতে থাকেন। চিকিৎসকের এহেন নির্দয় আচরণে শিশুটি ভয়ে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে শুরু করে। শিশুর মা, যিনি ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক উত্তরের পরিবর্তে রীতিমতো চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেন বলে অভিযোগ।
এক ২ বছরের নিরীহ শিশুর প্রতি এমন অমানবিক আচরণ একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে কল্পনা করা যায় না। চিকিৎসক মানেই হওয়া উচিত সহানুভূতির প্রতীক, ধৈর্যশীল, কোমল ও যত্নশীল। কিন্তু ডা. হৈমন্তী চৌধুরী নামক ওই চিকিৎসকের ব্যবহারে চিকিৎসক-পেশার গরিমা কলুষিত হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে হাসপাতাল চত্বরে শুরু হয় চরম উত্তেজনা। রোগীর পরিবার এবং হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। একসময় খবর পেয়ে শিলচর সদর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে ছুটে আসতে হয় কাছাড় জেলার একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারকেও।
রোগীর পরিবারের তরফে দাবি জানানো হয় যে অভিযুক্ত চিকিৎসক যেন প্রকাশ্যে তাঁর দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা ডা. পি. কে. চৌধুরী এবং অভিযুক্ত চিকিৎসক কোনও রকম সদুত্তর তো দেনইনি, বরং ঘটনার গুরুত্বকেই অস্বীকার করার প্রচেষ্টা করেন। এমন উদাসীন, অহংকারী ও গাফিলতিপূর্ণ মনোভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
শেষপর্যন্ত শিশুটির অভিভাবক থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে, পুলিশ ডা. হৈমন্তী চৌধুরীকে আটক করে শিলচর সদর থানায় নিয়ে যায় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য সামনে আসেনি। চৌধুরী আই ক্লিনিক নিয়ে এমন বিতর্ক এই প্রথম নয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও এই হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অবহেলা ও উচ্চ মূল্য আদায় নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠেছে। তবে এত ছোট এক শিশুর উপর হাত তোলা, তার মানসিক স্থিতি ভেঙে দেওয়া—এই প্রথম এবং গভীরভাবে নিন্দনীয় ঘটনা।
শিশুর উপর এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ, শিশু অধিকার সংস্থাগুলি, চিকিৎসক মহলের একাংশ ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা সকলেই একবাক্যে বলেন, এমন আচরণ শুধু পেশাগত শপথের লঙ্ঘন নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর রোগী—বিশেষত শিশুদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে সাহস না পায়।
এই ঘটনা আমাদের সামনে কঠিন প্রশ্ন তোলে—আজকের দিনে চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানবিকতা কোথায়? কে দেবে রোগীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার গ্যারান্টি? কতবার সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হবে এমন ‘উচ্চাভিলাষী’ চিকিৎসকদের হাতে? শিলচরের জনগণ আজ জবাব চাইছে, ন্যায়বিচার চাইছে এবং দাবী তুলছে—চৌধুরী আই ক্লিনিক ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক।