
মাওলানা মহবুবুর রহমান: ভারতের সংবিধান কেবল একটি দলিল নয়, এটি কোটি কোটি মানুষের আশা, বিশ্বাস এবং অধিকার রক্ষার মূল ভিত্তি। সেই সংবিধানের আলোতেই আমরা ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, এবং সকল ধর্মাবলম্বীর সহাবস্থানের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ সেই স্বপ্নকে এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ওয়াকফ, মুসলিম সমাজের এক গভীর আত্মিক বিষয়। এটি কেবল সম্পত্তি নয়—এটি আস্থা, দান, বিশ্বাস এবং ইবাদতের প্রকাশ। শত শত বছর ধরে মুসলমানরা নিজেদের উপার্জনের একটি অংশ, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে আসছেন—এই ওয়াকফ ব্যবস্থার মাধ্যমে। অথচ আজ সেই ধর্মীয় অধিকারেই সরকারের হস্তক্ষেপ এক গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। নতুন আইনে এমন সব ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা সীমিত করে জেলা প্রশাসকদের হাতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছে। ধর্মীয় সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব এখন রাজ্য ব্যবস্থার হাতে চলে যাচ্ছে, যা সরাসরি সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ—”ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে পরিচালনার অধিকার”-এর বিরুদ্ধে যায়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আইনটিতে একটি ধারা রাখা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র যারা ইসলাম ধর্মে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে বিশ্বাসী—তাঁরাই ওয়াকফে সম্পত্তি দান করতে পারবেন। এই বিধান শুধুই যুক্তিহীন নয়, এটি মুসলিমদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অধিকার এবং দান করার স্বাধীনতাকেও রাষ্ট্রের শর্তসাপেক্ষ করে তুলছে। এতে স্পষ্টতই ধর্মাচরণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (ধারা ২৫) লঙ্ঘিত হচ্ছে।এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ধর্মীয় অধিকারকে অনধিকারভাবে চ্যালেঞ্জ করে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় এক গুরুতর হস্তক্ষেপ। শুরু থেকেই দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম এই আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। শুধু অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড-এর আহ্বানে ৩৬ মিলিয়নেরও বেশি রিজেক্টিং ইমেল পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য সংগঠনে তত্ত্বাবধানেও আরো কয়েক মিলিয়ন ই মেইল পাঠানো হয়েছে হয়েছে। কিন্তু তবুও এসবকে কোনোও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি!এই শৈথিল্য আজ এক ব্যথিত প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে—জনতার কণ্ঠ কি আজ অনুচ্চারিতই থেকে যাবে?
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, ড্যেমেজ কন্ট্রোলে তৈরি করে দেওয়া যৌথ সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও বিরোধী পক্ষের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো একতরফা বাতিল করা হয়েছে, আর সরকার পক্ষের সংশোধনীগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি চরম অবমাননা। কমিটির বৈঠকে বিরোধীদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা কেবল একটি প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। যদিও কমিটির চেয়ারম্যান, বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পাল দাবি করেছেন যে, সকল সদস্যের মতামত গণতান্ত্রিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, বাস্তবতা হলো বিরোধী পক্ষের মতামতকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একপেশে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা জনগণের প্রতি অসম্মান। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এবং অন্যান্য মুসলিম সংগঠন বারবার স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, তারা কখনোই ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকারের হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না। ওয়াকফ সম্পত্তি মুসলিমদের ব্যক্তিগত দান, যা তাদের ধর্মীয় অধিকার। সরকারের অনধিকার প্রবেশ সম্পূর্ণ বেআইনি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতায় সরাসরি আঘাত।
বেঙ্গালুরুর বোর্ড সভায় সব মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে ঘোষণা করেছে যে, তারা তাদের উপাসনালয় এবং ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নেবে না। এরই মধ্যে, ২ এপ্রিল ২০২৫ সালে লোকসভায় এই বিলটি পাশ করা হয়েছে এবং ৩ এপ্রিল ২০২৫ সালে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়েছে। দেশের সমূহ মুসলিম সমাজ এই বিলের বিরুদ্ধে। এই প্রক্রিয়া দেশের মুসলিমদের তীব্র বিরোধিতার পরও চলছে, যা গভীর উদ্বেগজনক। প্রশ্ন ওঠছে, কেন মুসলিমদের প্রতি সরকারের এই অনৈতিক হস্তক্ষেপ? এদিকে সরকার এই বিল(এখন আইন ) কে ‘দরিদ্র মুসলিম’ হিতে দাবি করলেও ,বাস্তবতা হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে! অভিযোগ , সরকারের বর্তমানে দেশব্যাপী মুসলিমরা একের পর এক হিংসার শিকার হচ্ছেন! মুসলিমদের মারধর করা হচ্ছে, মব লিঞ্চিং করা হচ্ছে। ইত্যাদি।
মুলত, মুসলিমদের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সরকারের নয়, কারণ যাদের সম্পত্তি তাদেরই কর্তৃত্ব থাকবে। মুসলিমরা নিজেরাই তাদের সম্পত্তি দেখাশোনা করে আসছে দীর্ঘকাল। অথচ, সরকার তাদের সম্পত্তিতে অনধিকার প্রবেশ করতে মরিয়া। এর মাধ্যমে, সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট যে, তারা মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারকে বঞ্চিত করতে চাইছে। এই বিলটির মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে বিতর্কিত তা হলো, এতে বলা হয়েছে ওয়াকফ বোর্ডে কমপক্ষে দু’জন মহিলা এবং দু’জন অ-মুসলিম সদস্য থাকতে হবে। তবে, প্রশ্ন উঠছে, কেন অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এমন বিধান নেই? কেন শুধুমাত্র মুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্য থাকতে হবে? এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অসাম্য সৃষ্টি করবে। এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী। পরিতাপের বিষয় হলো দেশের সমূহ মুসলিমের বিরোধ সত্ত্বেও সরকার এই সংশোধনীতে একতরফা মনোভাব নিয়ে কাজ করছে, যা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি অবজ্ঞা।
সরকারের এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটি দেশের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের সমাজে গভীর ক্ষত তৈরি করবে। সরকার বলছে এই আইন মুসলিম সমাজ, বিশেষত মুসলিম নারীদের “হিত” বিবেচনা করেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই আইন প্রণয়নের সময় কোথায় ছিলেন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিরা? যারা ছিলেন মুসলিম সাংসদ সবাই এর বিরোধিতা করেছেন(আর এটাই আসলে পুরো ভারতবাসী মুসলিমদের কন্ঠ)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লোকসভায় সরকার পক্ষের কোনো মুসলিম প্রতিনিধিই নেই। এমনকি লোকসভা,রাজ্যসভা তথা দেশের কোনো বিধানসভায়ও কোনো মুসলিম নারী প্রতিনিধি নেই! এই আইন এতেই অনুমেয় এ আইন কতটুকু মুসলিম- হিতকর!
বিশ্লেষকদের মতে এই আইন কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে কোণঠাসা করার এক কৌশল। এই মুহূর্তে দেশের বৃহৎ সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান নাগরিকও মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কারণ তাঁরা জানেন—ধর্মীয় স্বাধীনতা কেবল সংখ্যালঘুদের বিষয় নয়, এটি ভারতের অস্তিত্ব ও আত্মার প্রশ্ন। একবার কারো অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে, পরবর্তীতে কার অধিকার যে খর্ব হবে, তা কেউ বলতে পারে না। এই প্রেক্ষাপটে, আমরা সংবিধানপ্রেমী সিংহভাগ ভারতবাসী ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় তথা আমাদের সম্মানিত মুখ্য বিচারপতির নিকট আবেদন জানাই—এই আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা যেন গভীরভাবে পুনঃমূল্যায়ন করা হয়। দেশের সংবিধান এবং মৌলিক অধিকার রক্ষায় আজ আপনার সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে ইতিহাসে আমরা কোন পথে চলব। সংবিধান কোনো কাগজের দলিল নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত চেতনা। এ চেতনার মৃত্যু হলে আমরা সবাই পরাজিত হব। আজ প্রশ্ন কেবল মুসলমানদের নয়—এটা ভারতের হৃদয়ের প্রশ্ন।আপনি কি সেই হৃদয়কে বাঁচাবেন না?