
ড. নিখিল দাশ শিলচর ১৩ এপ্রিল: বিনিয়োগ করলেই টাকা দ্বিগুণ এই মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলত এক বিশাল প্রতারণা চক্র। বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, দামি বাড়ি-গাড়ির ঝলক দেখিয়ে মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরির কৌশল নিয়েছিল অভিযুক্তরা। চক্রের মূল সদস্যরা হল শাকির, রাজদীপ, রশিদ, সুফিয়ান, মুস্তাফিজুর এবং ত্রিপুরার ধর্মনগরের পার্থ প্রতিম দেবনাথ। জানা গিয়েছে, অনলাইনে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের নাম করে বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রতারণা করা হয়েছে।
সাধারণ মানুষকে বলা হতো, নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখলে ৬০ দিনের মধ্যে ৩০ শতাংশ রিটার্নসহ মূল অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে। এতটাই মোহিত হতেন মানুষজন যে বিনিয়োগের পর বিনিয়োগ চলতেই থাকত। অভিযোগকারীদের সূত্রে জানা গেছে, রাজদীপ, শাকির, রশিদ, সুফিয়ান, মুস্তাফিজুর ও পার্থ প্রতিম দেবনাথ নিজেদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা সামাজিক মাধ্যমে প্রদর্শন করে বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করত। দামি গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণের ছবি, অভিজাত পার্টির ভিডিও ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মনে তাঁদের আর্থিক সক্ষমতার একটা মিথ্যা ইমেজ তৈরি করা হতো। শুধু বরাক বা ত্রিপুরা নয়, আশপাশের রাজ্যগুলিতেও এদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গিয়েছে। এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত থাকার আশঙ্কা করছেন তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম বিভাগ একযোগে তদন্ত শুরু করেছে।

বরাক উপত্যকায় সম্প্রতি শাকির এবং রাজদীপের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই, নতুন করে সামনে এসেছে ত্রিপুরার ধর্মনগর-কৈলাশহরের মহাপ্রতারক পার্থ প্রতিম দেবনাথের নাম। ভুয়ো অনলাইন ট্রেডিং-এর ফাঁদ পেতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে বেকার যুবক-যুবতীদের ঠকানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। শিলচর ও হাইলাকান্দি জেলার বহু যুবক-যুবতী কর্মসংস্থানের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পার্থ প্রতিম দেবনাথের প্রলোভনে পা দেন। তথাকথিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজের সুযোগ পাওয়ার আশায় অনেকে মোটা অঙ্কের অর্থও প্রদান করেন। কোর্ট এগ্রিমেন্টের ছত্রছায়ায়, আইনি রূপ দেয়ার অভিনয় করে তাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ত্রিপুরা সরকারের আই টি ভবনের ক্যাম্পাসের ভেতরেও ভুয়ো অনলাইন ট্রেডিং অফিস খুলে প্রতারণা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।
সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে সরকারি স্থাপনার ভেতর অফিস খুলে সে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের অপব্যবহার করেছে। হাইলাকান্দির এক যুবক, অর্ণব মল্লিক (নাম পরিবর্তিত) জানান, আমাকে পার্থ প্রতিম দেবনাথের অফিস থেকে ফোন আসে। তারা বলেছিল, আপনি যদি অনলাইন ট্রেডিং শিখতে চান, তাহলে খুব ভালো সুযোগ আছে। বিশ্বাস করে আমি ৩০ হাজার টাকা প্রদান করি, কাজের আশায়। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, সে একটি প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। তাদের অফিসে গিয়ে দেখলাম, কোনো প্রশিক্ষণই দিচ্ছে না, শুধুমাত্র আরো টাকা পেতে আমি বাধ্য হচ্ছিলাম।

আরেক ভুক্তভোগী, শিলচরের এক যুবতী শ্রাবণী দেবী (নাম পরিবর্তিত) জানিয়েছেন, আমাদের এলাকার এক যুবক পার্থ প্রতিমের প্রশিক্ষণ নেয়, তারপর সে আমাকেও প্রলোভন দেখিয়ে বলল, ‘তুমি যদি এ ব্যবসায় যোগ দাও, তোমার জীবনে আর কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা থাকবে না।’ কাজের খোঁজে আমি টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। পরে যখন বুঝতে পারলাম, আমি প্রতারণার শিকার, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফোনে তারা সব সময়ই ‘আপনার টাকা ফেরত চলে আসবে বলেছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত এক টাকাও ফেরত পাইনি।
শিলচর শহরের আরও এক যুবক, রূপম দাস (নাম পরিবর্তিত) বলেন, মাঝে মাঝে পার্থ প্রতিম দেবনাথ তার বিলাসী জীবনযাপনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতো, যা দেখে আমার মনে হয়েছে, সে সত্যিই ভালো ব্যবসায়ী। আমি বিশ্বাস করেছি, কিন্তু পরে জানলাম যে, এটি ছিল তার প্রতারণার কৌশল। তার অফিসে গিয়ে দেখলাম, কোথাও কোনো ট্রেডিং প্রশিক্ষণ ছিল না, শুধুমাত্র নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ পাতা ছিল।
প্রতারিত যুবক-যুবতীরা শিলচর সদর থানায় একাধিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও, পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত নিরাশাজনক বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, পুলিশ তদন্তে গাফিলতি করছে, ফলে প্রতারক পার্থ প্রতিম দেবনাথ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। তার ভেলকিবাজি এবং উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আরও অনেক যুবক-যুবতীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগী মানুষ। এক ভুক্তভোগী বলেন, আমি থানায় গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা বলল, আমরা শুধু তদন্ত করছি। কয়েক মাস মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু কোনো ফল পায়নি। পুলিশ যদি দ্রুত কাজ না করে, তাহলে আরো অনেক মানুষ এই প্রতারণার শিকার হবে। জনগণের একাংশ মনে করছেন, এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামীতে আরও বৃহত্তর মাপের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটতে পারে। প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অবিলম্বে পার্থ প্রতিম দেবনাথের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি অসমে এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা চক্রের পর্দাফাঁস হয়েছে। অনলাইনে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক ভুয়ো সংস্থা। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা রাজ্যবাসীকে সরাসরি সতর্ক করেছেন। তাঁর স্পষ্ট বার্তা টাকা দ্বিগুণ হওয়ার মিথ্যা প্রলোভনে পা দেবেন না। নিজের কষ্টের অর্থ এই ধরনের প্রতারণামূলক স্কিমে বিনিয়োগ করে সর্বনাশ ডেকে আনবেন না।
মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, রাজ্য জুড়ে সক্রিয় এই দুর্নীতি চক্রের মূল অভিযুক্তদের খুব শীঘ্রই আইনের জালে আনা হবে। ইতিমধ্যেই পুলিশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করেছে। অসম প্রশাসনের কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি প্রাথমিক রিপোর্টও জমা পড়েছে, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— এই ভুয়ো অনলাইন ট্রেডিং সংস্থাগুলি ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোনও গাইডলাইন মানছে না। বিনিয়োগের নামে তারা শুধু প্রতারণাই করছে, আইনি শর্তাবলী বা ন্যূনতম নিয়ম-কানুনেরও তোয়াক্কা করছে না। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও আর্থিক সচেতনতা যাঁদের কম, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন প্রতারণার অভিযোগ আসছে। যারা একমুঠো সঞ্চয় নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছিলেন, তাঁরা আজ সর্বস্বান্ত।
প্রশাসন দেরিতে হলেও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই প্রতারণা এতদিন চলছিল কিভাবে? কারা এদের পেছনে মদত দিচ্ছিল? প্রশাসনেরই বা এতদিন নজর পড়ল না কেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর পেতে রাজ্যবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পুলিশের আশ্বাস, মুখ্যমন্ত্রীর সতর্কতা— সবই আশার কথা বটে, তবে বাস্তবে প্রতারিত মানুষদের টাকা ফিরবে কি না, কিংবা দোষীরা যথাযথ শাস্তি পাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বর্তমানে প্রশাসন এই চক্রের সমস্ত নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে অভিযান শুরু করেছে। অভিযুক্তদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চলছে। তদন্তে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।