
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর ৫ এপ্রিল: বর্ষার মরশুম শুরু হতেই শিলচরবাসীর কপালে আবারও চিন্তার ভাঁজ। তবে এ চিন্তার মূল কারণ প্রকৃতির রোষ নয়—বরং প্রশাসনের চূড়ান্ত অব্যবস্থা এবং নজিরবিহীন উদাসীনতা। শহরের নর্দমাগুলো যেন এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অপরিষ্কার পড়ে থাকা নর্দমা, অকার্যকর জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা আর ভগ্নদশাগ্রস্ত রাস্তাঘাট—এসব মিলিয়ে শিলচর আজ এক ‘জীবন্ত দুর্ভোগের শহর’ হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের বিধ্বংসী বন্যার পর মানুষের বুক ফাটা কান্না, সর্বস্ব হারানোর আর্তনাদ—সবকিছু কি এত দ্রুত ভুলে গেল প্রশাসন? শহরবাসীর সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পরেও কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উপরন্তু অব্যবস্থার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরের আনাচে-কানাচে নর্দমার জল উপচে রাস্তা ভাসিয়ে দিচ্ছে, আবর্জনার দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া দায়।
সামান্য বৃষ্টি হলেই গোটা শহর যেন এক বিশাল জলাশয়ে পরিণত হবে, এটা এখন অবধারিত সত্য। কিছু কিছু এলাকায়—যেমন বিলপার, শরৎপল্লী, বৃহত্তর উত্তরাঅঞ্চল, পদ্মনগর, নিউমার্কেট, ১ম লিংক রোড সহ বিভিন্ন এলাকায়—বৃষ্টির জমা জলে চলাচল করা তো দূরের কথা, হাঁটাও সম্ভব হবে না। প্রশাসনের ব্যর্থতা আজ এতটাই নগ্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে যে, শহরবাসীর মনে প্রশ্ন জাগছে—শাসক ও জনপ্রতিনিধিরা কি শুধুই ভোটের সময় মানুষের দরজায় আসে? দুর্দশার দিনে তাদের মুখে তালা পড়ে যায় কেন? নর্দমা পরিস্কার ও রাস্তা মেরামতির মতো মৌলিক কাজ যেখানে বছরের পর বছর উপেক্ষিত, সেখানে উন্নয়ন বা আধুনিক শহর নির্মাণের বুলি আসলে জনগণের সঙ্গে নির্লজ্জ প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। জনদুর্ভোগের ভয়াবহ চিত্র দেখে প্রশাসনের টনক নড়বে কি না, তা নিয়ে এখন প্রবল সন্দেহ! অথচ আরেকটি ২০২২-এর পুনরাবৃত্তি হলে দায় কার, তার উত্তর দেবার মতো সাহস দেখাবে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ?শিলচরের সর্বস্তরের মানুষ আজ একটা কথাই বলছেন—”আমরা ভোট দিয়েছিলাম উন্নয়নের জন্য, সর্বনাশের জন্য নয়!

এদিকে শিলচরের সোনাই রোডের বাসিন্দাদের জন্য নতুন এক দুশ্চিন্তার মেঘ জমে উঠেছে। সম্প্রতি এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটির পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ চলছে। একদিকে রাস্তাটি আগের তুলনায় অনেক উঁচু ও মজবুত হওয়ায় যানবাহন চলাচলে সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য তা এক গভীর সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাটি উঁচু করার ফলে আশপাশের ঘরবাড়িগুলো এখন তুলনামূলকভাবে নিচু অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে বর্ষার সময় সামান্য বৃষ্টিতেই সেই বাড়িগুলোতে জল ঢুকে পড়ার প্রবল আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জল নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা বা পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। ফলত, নালা-নর্দমার অবস্থা এখন সংকীর্ণ এবং অপ্রতুল, যা জমা জল দ্রুত বের করতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, “রাস্তা তো উঁচু করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের বাড়িগুলো থেকে জল বের হওয়ার কোনো সুব্যবস্থা করা হয়নি। বর্ষার সময় সামান্য ভারী বৃষ্টি হলেই চারদিক জলমগ্ন হয়ে পড়বে। ঘরবাড়ি হয়ে উঠবে বসবাসের অযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়নের নামে যদি মানুষের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তবে সেই উন্নয়নের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বৈকি! বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় কোনো রাস্তা উঁচু করার পাশাপাশি আশপাশের এলাকার জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক। নইলে, উঁচু রাস্তাগুলো ‘জলাবদ্ধতার দেয়াল’ হিসেবে কাজ করবে, আর সাধারণ মানুষকে এর ভয়াবহ মাশুল গুনতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠছে, বর্ষা যখন আর কিছুদিনের মধ্যেই আসন্ন, তখন দ্রুত কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা? নাকি, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলমগ্ন বাড়িতে দুর্ভোগ পোহানোই সোনাই রোডের বাসিন্দাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে? জনগণের দাবি, অবিলম্বে সোনাই রোডের পাশে আধুনিক ও সুবিস্তৃত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক, যাতে বর্ষার সময় নির্বিঘ্নে জল নিষ্কাশন সম্ভব হয়। নইলে, সড়ক উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়ে সাধারণ মানুষ চরম দুর্দশার শিকার হবেন। সময় থাকতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এখন এলাকাবাসীর একমাত্র কামনা।
শুধু শহর নয়, এবার আরও বড় বিপদের মুখে পড়তে চলেছে শিলচর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ তো হয়ইনি, বরং বছরের পর বছর কেবল আশ্বাসের ফুলঝুরি ছাড়া বাস্তব কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরাক নদী ও সংলগ্ন অন্যান্য জলাশয়গুলির ওপর লাগাম পরানোর মতো কার্যকর কোনো বাঁধ আজও নির্মিত হয়নি। ফলে আবারও আশঙ্কা, সামান্য অতিবৃষ্টিতেই জল উপচে পড়বে, আর নিমেষে ডুবে যাবে শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা।
প্রতিবার বর্ষা মৌসুমের আগমনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় — ‘চলছে পরিকল্পনা’, ‘শীঘ্রই কাজ শুরু হবে’, ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। সামান্য বৃষ্টিতেই শিলচরের রাস্তাগুলো নদীতে পরিণত হয়। কোথাও হাঁটুসমান, কোথাও বা কোমরসমান জল জমে সাধারণ মানুষের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তার ওপর ভাসমান দোকানপাট, ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া — যেন নিয়মিত দৃশ্যপট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের স্মৃতি আজও তাজা। সে সময়কার বন্যায় শিলচর চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। হাজার হাজার মানুষ দিনের পর দিন জলবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। অগণিত মানুষ তাদের আশ্রয় হারিয়েছিলেন, আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল কয়েক কোটি টাকারও বেশি। অথচ, সেই সময়কার করুণ অভিজ্ঞতা থেকেও প্রশাসন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এবারও চিত্র অভিন্ন। বাঁধ মেরামত হয়নি, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি, এমনকি জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য কোনো বিকল্প পরিকল্পনাও দেখা যায়নি। এক কথায়, জনগণের দুর্ভোগ যেন নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আর এই গাফিলতির মাশুল দিতে হতে পারে সাধারণ জনগণকেই — যাদের জীবন-জীবিকা বর্ষা নামলেই হুমকির মুখে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে তাই উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন — আমরা কি আবার ২০২২ সালের মতো দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত? নাকি এবার আর বাঁচার কোনো উপায়ও থাকবে না?