
বেআইনি স্কুল পরিচালনা, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়
ড. নিখিল দাশ, বরাকবাণী, শিলচর, ৩০শে জানুয়ারিঃ শিক্ষা মানবজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কিন্তু যখন এই শিক্ষাব্যবস্থার আড়ালে চরম প্রতারণা চলে, তখন তা শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎই ধ্বংস করে না, পুরো সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কলাইনের উইজডম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর অভিযোগগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, কিছু অসাধু ব্যক্তি শিক্ষাকে ব্যবসার মাধ্যম বানিয়ে শিক্ষার্থীদের ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
একটি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সরকারি অনুমোদন থাকা আবশ্যক। তবে আশ্চর্যের বিষয়, দীর্ঘদিন ধরে উইজডম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই পরিচালিত হয়ে আসছে। শিলচরের জেলা স্কুল পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্কুলটির কোনো বৈধ রেকর্ড নেই। অর্থাৎ, এটি কোনো শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতিও পায়নি। ফলে এখান থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই, যা তাদের উচ্চশিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করবে।
প্রত্যেক অভিভাবক তার সন্তানকে ভালো ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য স্কুলে পাঠান। কিন্তু যদি সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবৈধ হয়, তাহলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কোনো মূল্য থাকে না। এই স্কুলে যারা এতদিন পড়াশোনা করেছে, তারা এখন বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে চলেছে। কারণ, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো স্বীকৃত বোর্ডের অধীনে না থাকায় তারা উচ্চশিক্ষা বা সরকারি-বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বড় বাঁধার সম্মুখীন হবে। এতদিন ধরে একটি অবৈধ স্কুল কীভাবে চালু ছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষা দপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন কি একেবারেই অবগত ছিল না, নাকি তাদের নীরবতার পেছনে কোনো স্বার্থ জড়িত? সাধারণ জনগণের মনে এখন এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আরটিআই (তথ্যের অধিকার) আইনের মাধ্যমে। ডেপুটি স্কুল পরিদর্শক গণেশ হরিজন জানিয়েছেন যে, একটি স্কুল সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং সরকারি দপ্তরের কাছে এর কোনো নথিপত্র নেই। এই ঘটনা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, সমাজের জন্যও গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। অনুমোদিত স্কুলের ক্ষেত্রে শিক্ষা দপ্তরের রেজিস্ট্রেশন, স্বীকৃতি, শিক্ষক নিয়োগের নির্দিষ্ট নিয়ম, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ এবং পরীক্ষার বৈধতা থাকে। কিন্তু যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এই নিয়ম না মেনে গোপনে চলে, তাহলে সেটি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ংকর খেলা ছাড়া কিছু নয়। এই বেআইনি স্কুলটি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রছাত্রীদের বিভ্রান্ত করছে, অথচ প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—এই স্কুল থেকে যারা পাস করেছে বা যারা বর্তমানে এখানে পড়ছে, তাদের সনদের বৈধতা কী? যেহেতু সরকারি নথিতে স্কুলটির কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই এদের দেওয়া সনদ যে স্বীকৃত নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর অর্থ, এখানকার ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারবে না। এই প্রতারণার শিকার হচ্ছে নিরীহ ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকরা। প্রশ্ন জাগে, প্রশাসন কী করছিল? যদি স্কুলটি অবৈধ হয়, তবে এতদিন ধরে কীভাবে এটি চালু ছিল? স্থানীয় শিক্ষা দপ্তর কি একবারও তদন্ত করেনি? এটি প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা এবং দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। এমনকি অভিভাবকরাও নিশ্চিন্তে ছিলেন যে, তাদের সন্তানরা একটি স্বীকৃত স্কুলে পড়ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি লাভবান হয়েছে।
উইজডম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা কি ভবিষ্যতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে, কিংবা তাদের শিক্ষাগত সনদ চাকরি বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে—এটি এখন এক বড় প্রশ্ন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুলটি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি অনুমোদন ছাড়া স্কুল চালিয়ে আসছে, যার ফলে শিক্ষার মান এবং আইনগত বৈধতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু পাঠদান নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ গড়ার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু যখন সেই প্রতিষ্ঠানই বেআইনিভাবে পরিচালিত হয়, তখন তা শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো সমাজের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি উইজডম সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের বেআইনি বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এবার জেগে উঠবে? নাকি ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থেকে যাবে? জনগণের দৃষ্টি এখন প্রশাসনের দিকে।