মন্ত্রী রণোজ পেগুর বিভাগে ঠিকাদারির সিণ্ডিকেট!

বরাকবাণী প্রতিবেদন, গুয়াহাটি, ২৮ জানুয়ারি: রাজ্যের স্কুল পড়ুয়াদের ইউনিফর্ম সরবরাহ নিয়ে বড় ধরণের কেলেঙ্কারি আগেই সামনে এসেছে। এবার মন্ত্রী রণোজ পেগুর অধীনস্ত আপল্যান্ড ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের আরেক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। বর্তমানে চারজন বিতর্কিত ঠিকাদার রাজ্যের আদিবাসী উচ্চভূমি উপজাতিদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন মন্ত্রী পেগুর বদান্যতায়। অতীতে বহু কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ঠিকাদার মধুসূদন শাহির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। এই চারজন বিশেষ ঠিকাদারকে সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন করে জেম পোর্টালের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান না করে ন্যস্ত স্বার্থে অসম টেন্ডারের মাধ্যমে আকাশছোঁয়া দামে পণ্য সরবরাহের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই ঠিকাদাররা হলেন কমলনাথ, মধুসূদন শাহি, কোশেশ্বর গগৈ এবং শরৎ দেউরি। এই চার ঠিকাদার কীভাবে উচ্চভূমি উপজাতি বিষয়ক দফতরে সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনা তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

৫০ শতাংশের বেশি তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যা থাকা গ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ২০২১-২২ সালে প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনা চালু হয়। ২০২৫-২৬ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে। অসমে ২০২২-২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনার কাজ শুরু হয়। তখন থেকে অসম সরকার ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনার অধীনে আদিবাসী গ্রামের উন্নয়নের জন্য ২৪২.৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। তবে আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, এই ২৪২.৩৭ কোটি টাকার মধ্যে ২২০.৭৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে উক্ত চার ঠিকাদারের সিন্ডিকেটকে।

তথ্য জানার অধিকার আইনের (আরটিআই) মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ঠিকাদার কমলনাথের জেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আদর্শ গ্রাম যোজনার অধীনে ৪৭.৬৪ কোটির ঠিকা পেয়েছে। যেখানে ঠিকাদার মধুসূদন শাহির ট্রেড সাপ্লাই ইন্ডিয়া ৭৯.৪১ কোটি টাকার, কোশেশ্বর গগৈর ইউরেকা ট্রেড ৪৪.৩৭ কোটি এবং শরৎ দেউরির এসএস এন্টারপ্রাইজ ৪৯.৩৭ কোটি টাকা মূল্যের ঠিকা পেয়েছে। এই চার ঠিকাদারের সিন্ডিকেট কীভাবে উপজাতি বিষয়ক দফতরকে তাদের পকেটে পুরে রেখেছেন, তা জানতে হলে ওই প্রকল্পের বার্ষিক প্রতিবেদনে চোখ দিতে হবে।

অসমে প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনার বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২২-২৩ সাল থেকে। সেই বছরে এই প্রকল্পের অধীনে মোট ১৩২.৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল৷ সে বছর কমলনাথকে ২০.০৬ কোটি টাকা, মধুসূদন শাহিকে ৫৬.৯৮ কোটি টাকা, কোশেশ্বর গগৈকে ২১.৭৬ কোটি টাকা এবং শরৎ দেউরিকে ২৬.৪৩ কোটি টাকার ঠিকা দেওয়া হয়েছিল। এর অর্থ হল, ১৩২.৪২ কোটি টাকার ঠিকার মধ্যে ১২৫.২৩ কোটি টাকাই এই চার-মাথার সিন্ডিকেটকে দেওয়া হয়। ২০২৩-২৪ সালে প্রধানমন্ত্রী আদি আদর্শ গ্রাম যোজনার অধীনে ৮৭.৪৭ কোটির ঠিকার মধ্যে কমলনাথকে ১৯.৬৪ কোটি টাকা, মধুসূদন শাহিকে ১৮.৬৯ কোটি টাকা, কোশেশ্বর গগৈকে ১৮.৭৮ কোটি এবং শরৎ দেউরিকে ১৯.১০ কোটি টাকার ঠিকা দেওয়া হয়েছিল। এই বছর, মধুসূদন শাহি অ্যান্ড কোম্পানিকে ৭৬.২১ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে এই প্রকল্পের অধীনে ২২.৭২ কোটি টাকার ঠিকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে কমলনাথকে ৭.৯৪ কোটি টাকা, মধুসূদন শাহিকে ৭.৪৮ কোটি টাকা, কোশেশ্বর গগৈকে ৩.৮৮ কোটি টাকা এবং শরৎ দেউরিকে ৩.৮৮ কোটি টাকার ঠিকা দেওয়া হয়। অতীতের মতো এই বছরও, প্রধানমন্ত্রী আদর্শ গ্রাম যোজনায় ২২.৭২ কোটি টাকার মধ্যে চার-মাথার ওই সিন্ডিকেট ১৯.৩৫ কোটি টাকার ঠিকা লাভ করে।

বিভাগীয় মন্ত্রী ডাঃ রণোজ পেগুর ‘রান্নাঘর’-এর লোক হয়ে ওঠা মধুসূদন-শাহি অ্যান্ড কোম্পানির এতই প্রভাব যে তাদের জন্য ‘গভর্নমেন্ট ই মার্কেটপ্লেস’-এর পরিবর্তে কেবল অসম টেন্ডারের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়। যেখানে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি রাজ্যের অর্থ বিভাগ ‘গভর্নমেন্ট ই মার্কেটপ্লেস’ দ্বারা সমস্ত সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের দরপত্র আহ্বান বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করে। অসম পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০২০ অনুসারে, ইসিএফ/নং ৩২৭৬৩২-এর মাধ্যমে সমস্ত সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য জেম পোর্টালের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা বাধ্যতামূলক। সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি স্বচ্ছ করা এবং রাজকোষের অর্থের সাশ্রয় করাই এই আদেশের লক্ষ্য ছিল। তবে ডাঃ রণোজ পেগুর বিভাগ মধুসূদন-শাহিদের সিন্ডিকেট যাতে উচ্চ হারে পণ্য সরবরাহ করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে বলে মনে করা হচ্ছে। এবার স্বচ্ছতার বুলি প্রচারকারী মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্চভূমি উপজাতি বিষয়ক বিভাগের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করেন, সেটাই দেখার।

  • Related Posts

    হাইলাকান্দি জেলা পরিষদ নির্বাচন: বিজেপির ঝড়, নির্দল ও কংগ্রেসের হালকা হাওয়া

    বরাকবাণী প্রতিবেদন  হাইলাকান্দি ১৩ মেঃ রবিবার সকাল আটটা থেকে হাইলাকান্দি জেলার আটটি জেলা পরিষদ আসনে ভোট গণনা শুরু হয়। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বিরতিহীনভাবে ভোট গণনার পর সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,…

    রাজ্যে ২০১৯-২০২৪ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১৯২ কোটি

    অ্যাডভান্টেজ অসম দ্বিতীয় সংস্করণের সাফল্য নিয়ে আশাবাদী সরকার বরাকবাণী প্রতিবেদন, গুয়াহাটি, ৩১ জানুয়ারি: অসমে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২২.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ১৯২…