জনমতকে উপেক্ষা করে জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগ্রাম কমিটির মিছিল

প্রথমে স্টেশনরোডস্থিত নেতাজী মূর্তিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন ছাত্র সংগ্ৰাম কমিটির আহ্বায়ক প্রজ্জ্বল দেব, সঞ্চিতা শুক্ল, কিরণ কোঁহার, কার্যকরী কমিটির সদস্য সুজিৎ কুমার পাল, কোষাধ্যক্ষ জয়দীপ দাস, দাহার খান ও ছাত্র নেতা ইয়াহি আহমেদ চৌধুরী। স্বাধীনতা আন্দোলনের আপোষহীন ব্যক্তিত্বের মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ও লড়াইয়ে তীব্র সংকল্প গ্ৰহণ করে মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ছাত্রীরা শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে শহরের প্রধান প্রধান পথ অতিক্রম করে জেলা আয়ুক্ত কার্যালয়ের সম্মুখে পৌঁছায়।

সেখানে উপস্থিত ছাত্র ছাত্রীরা “অন্যায় ও অগণতান্ত্রিকভাবে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত মানছি না, মানব না, সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে, করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সকল ছাত্র -ছাত্রী এক হোন, সাম্প্ৰদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্ৰামের শপথ নিন, রাজপথে আওয়াজ তুলুন করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন বাতিল কর, করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়ছি, লড়ব, স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যমন্ডিত করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলছে চলবে, সংগ্ৰামের শপথ নিন, করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন বিরোধী আন্দোলনে দলে দলে যোগ দিন, সংগ্ৰামের ময়দানে ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক এক হোন ইত্যাদি শ্লোগানে কার্যালয় চত্বর উত্তাল করি তুলে।

বিক্ষোভ চলাকালে সেখানে বক্তব্য রাখেন সংগ্ৰাম কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক প্রোজ্জ্বল দেব। তিনি বলেন আসাম সরকার গত ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে কেবিনেট মিটিংয়ে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করে। রাজ্য সরকার করিমগঞ্জ জেলার জনসাধারণের মতামতকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, ছাত্র-শিক্ষক সংগঠন, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আলাপ আলোচনা না করে সমস্ত ধরণের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে জেলার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন যে করিমগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের দাবিতে কোনো মিটিং, মিছিল হয়নি।

অথচ কেবলমাত্র সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে বিভাজনের রাজনীতি তীব্রতর করতে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনোত্তর কালের বহু ছাত্র ও গণ আন্দোলনের ঐতিহ্যমন্ডিত করিমগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। তিনি বলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপিন চন্দ্র পাল সহ প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন। এইসব মহান ব্যক্তিরা সর্বদাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করেছিলেন। অথচ সরকার এদের অসাম্প্রদায়িক এবং সমন্বয়ের চিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে এই অন্যায় সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে।

এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিকে বিকৃত করে এই মহান ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। অথচ এটাই ইতিহাস যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা প্রশাসনিক সুবিধের কথা বলে সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে যখন বঙ্গ দেশকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, কবিতার মধ্যে দিয়ে বাংলার জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও দেশাত্মবোধক চেতনা জাগ্রত করতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও বিশিষ্ট সংগ্ৰামী ব্যক্তিদের ও জনগণের দুর্দমনীয় সংগ্ৰামের কাছে নতি স্বীকার করে বৃটিশ শাসক বঙ্গ বিভাজনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়।

বঙ্গ ভংগ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সারা দেশব্যাপী যে দুর্বার স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে উঠবে সেখানে ভাষা, বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার থাকবে। এই নতুন সমাজে বৈচিত্র্যর মধ্যে ঐক্য থাকবে।স্বাধীনতা আন্দোলন সময়কালের মনিষীদের চিন্তাকে পায়ে মাড়িয়ে জেলার নাম পরিবর্তনের অধ্যাদেশে জারি করা হয় তার সঙ্গে এই অঞ্চলের পরিকাঠামোগত ও জনজীবনের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই।

অপ্রয়োজনীয় এবং অযৌক্তিক এই পরিবর্তন কার্যকরী করতে সরকারি কোষাগার থেকে বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হবে। তাছাড়া নথিপত্র পরিবর্তনে একদিকে যেমন জনসাধারণকে যথেষ্ট আর্থিক বোজা বহন করতে হবে অন্যদিকে অভাবনীয় হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি আরো বলেন স্বাধীনতার পর থেকেই উগ্ৰপ্রাদেশিকতাবাদী শক্তির বারংবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন বরাক উপত্যকার জনগণ।

ভোটার তালিকা সংশোধন, ডি ভোটার, ডিটেনশন কেম্প, এন আর সি নবায়ন সহ বিভিন্ন ধরণের  চক্রান্তে বরাক উপত্যকার জনগণ বারবার হেনস্থা হয়েছেন। ১৯৬১, ১৯৭২, ১৯৮৬ সালে বরাক উপত্যকার জনগণের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বরাক উপত্যকার হিন্দু- মুসলিম বাংলাভাষী, মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, হিন্দিভাষী জনগণ।

বরাক উপত্যকার যুবক যুবতীরা কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ না পেয়ে বরাক উপত্যকার যুবকেরা বহিঃরাজ্যে গিয়ে দুর্ভোগে পড়ছে। বর্তমান সরকার বরাক উপত্যকার দুটো বিধানসভা কেন্দ্র কমিয়ে দিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বৃদ্ধি করেছে, করিমগঞ্জ জেলার জেলা পরিষদ কেন্দ্রের সংখ্যা কর্তন করা হয়েছে। বরাক উপত্যকায় যে সব সরকারি কার্যালয় রয়েছে তাতে পূর্বে স্থানীয় বেকার যুবক যুবতীদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর বিভিন্ন পদে চাকুরী জুটত বর্তমানে নিয়ম পরিবর্তন করে স্থানীয় বেকারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।

সম্প্রতি এডিআরই পরীক্ষার ফলাফলে চরম বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের বাজেটে বরাক উপত্যকার প্রতি চরম উপেক্ষা করা হয়েছে। আসামের মধ্যে একমাত্র আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য ছাত্র ছাত্রীদের সর্বভারতীয় স্তরের যোগ্যতা নির্ণায়ক গরীব ছাত্র স্বার্থবিরোধী সিইউইটি পরীক্ষার কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র করিমগঞ্জ জেলায় গতবছরের মতো এইবার ও স্থাপন করা হয় নি।

এছাড়াও বরাক উপত্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল ইত্যাদির দুরবস্থা দেখলেই আসাম সরকারের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী, সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠে। ছাত্র সংগ্ৰাম কমিটির পক্ষ থেকে জেলা আয়ুক্তের মাধ্যমে রাজ‍্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট স্মারকপত্র প্রেরণ করা হয়।

Related Posts

দুই বছর ধরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ, তবুও শুরু হয়নি কাজ বর্ষায় গর্তে জমে জল, প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত

মইনুল হক বরাকবাণী প্রতিনিধি শ্রীভূমি ২৯ মেঃ করিমগঞ্জ জেলার অন্তর্গত মৈনা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় অবস্থিত ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের বর্তমান পরিস্থিতি যেন এক মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে সড়ক জুড়ে…

বানরের উপদ্রব ঠেকাতে হাইলাকান্দিতে তৎপর বন বিভাগ

বরাকবাণী প্রতিবেদন হাইলাকান্দি, ২৯ মেঃ হাইলাকান্দি জেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে বহুদিন ধরে বানরের উপদ্রবে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন গ্রামবাসীরা। এছাড়াও শহরে অন্তর্গত লালা সার্কেলের অধীনে থাকা মনাছড়া লক্ষিনগর এলাকার মানুষের রাতের ঘুম ছিনিয়ে…

Created with Snap