
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ২২ এপ্রিল: একদিকে যখন আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তোড়জোড়ে সরগরম গোটা বরাক উপত্যকা, অন্যদিকে তখনই গোপন আঁধারে শিলচর শহরের বুক চিরে ছড়িয়ে পড়ছে এক বিপজ্জনক ভাইরাস—আইপিএল জুয়া। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ মানেই একদিকে ক্রিকেট প্রেমের উত্তেজনা, আনন্দ, আর অন্যদিকে শিলচরের একাংশের কাছে এটি যেন পরিণত হয়েছে অবৈধ আয়ের মোক্ষম সুযোগে। শহরের কোণে কোণে এখন চলছে আইপিএল জুয়ার জমজমাট আসর, আর প্রশাসন যেন নীরব দর্শক!
প্রথম দিকে কেউই ভাবেননি ক্রিকেট ঘিরে এই উন্মাদনা কতটা গভীর অন্ধকার নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা দিনকে দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আজকের দিনে শহরের প্রায় প্রতিটি অলিগলিতে, ক্যাফে-চায়ের দোকানে কিংবা কলেজ চত্বরে কান পাতলেই শোনা যায় ম্যাচ নিয়ে বাজির অঙ্কের হিসেব-নিকেশ। আর এই অশুভ প্রবণতা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক অদৃশ্য বিষ।
শিলচরের বুকিরা এখন যেন অনলাইন আর অফলাইনের এক দুর্ধর্ষ জোট গঠন করেছে। প্রযুক্তির সুবিধাকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে শক্তিশালী জুয়া নেটওয়ার্ক, যার জাল ছড়িয়ে পড়েছে শরৎপল্লী, সোনাই রোড, কনকপুর, লিংক রোড, ইটখোলা, মেহেরপুর, তারাপুর, বিলপার থেকে শুরু করে শহরতলীর বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আইপিএল বুকিদের নেতৃত্বে রয়েছেন পরিচিত কয়েকটি নাম, গোপাল দেবনাথ, সহদেব পাল, রোহিত চক্রবর্তী, মান্না দাস (টিটন), নবীন জৈন, সৌরভ রায়, সুমন সাহা, প্রীতম দাস, সঞ্জয় ঘোষ, রূপম সাহা।

এদের ছায়া অবলম্বন করে ছায়াচরিত্রের মতো কাজ চালাচ্ছে বিশাল, পোচন, কুটুস, পার্থ, টটো ও আরও অনেকেই। অভিযোগ, এদের অনেকেই দিনের বেলায় সমাজের সম্মানিত নাগরিক কিন্তু রাত হলেই বদলে যায় মুখোশ। একটা সময় ছিল যখন ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন ছিল ডিগ্রি, চাকরি আর প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এখন অনেকের কাছেই রাতারাতি ধনী হওয়ার মোহ জাঁকিয়ে বসেছে। “বেটিং অ্যাপ” ডাউনলোড করে, ১০০ টাকা দিয়ে শুরু করে লাখ টাকার বাজি এই আশার জাল বিছিয়ে বুকিরা ফাঁদে ফেলছে তরুণ প্রজন্মকে।
অনেকেই শুরুতে কিছু টাকা জিতে লোভে পড়ে, পরে ধার করে, বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বা নিজের মোবাইল বিক্রি করে বাজি খেলছে। হারলে আর ফেরার উপায় থাকছে না। কেউ কেউ মদ-নেশা, কেউ আবার মানসিক অবসাদে জড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক একাধিক আত্মহত্যার ঘটনার পিছনেও আইপিএল বেটিং জড়িত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মনোবিদেরা।

বুকিদের নাম জানা, এলাকা চিহ্নিত, এমনকি তাদের কাজের ধরন সম্পর্কেও প্রশাসনের কাছে বিস্তর তথ্য থাকলেও এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অনেকের অভিযোগ, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার পকেটেই রয়েছে এই বুকিরা, যার ফলে বুকিদের থামানোর কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না পুলিশ। শহরের এক প্রবীণ নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিলচর আজকাল রাত ১০টার পর এক ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ শহরে পরিণত হচ্ছে। অথচ প্রশাসন জানেও, দেখেও না দেখার ভান করছে। কাকে বলব? কোথায় যাব?
আরেক কলেজ অধ্যাপক বলেন, আমার ছাত্রদের অনেকেই এখন রাতভর মোবাইলে ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত। ক্লাসে ঘুমায়, পড়াশোনার দিকে মন নেই। এদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কে দায় নেবে? বিশেষ সূত্রে খবর, বর্তমানে আইপিএল জুয়া রোধে উপর মহল থেকে জেলার পুলিশ প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে একাধিক বুকির তালিকা। এমনকি কিছু গোপন অডিও কল, ট্রানজেকশন ডেটাও জোগাড় করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, শীঘ্রই বড় মাপের অভিযান শুরু হতে পারে।
তবে ততদিনে কত যুবক যে সর্বস্বান্ত হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ থাকছেই। শিলচরের সচেতন মহলের দাবি, এখনই প্রশাসনের ঘুম ভাঙানো দরকার। শুধু জুয়া নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে মাদক, লোন শার্কিং, চুরি, এমনকি অপরাধমূলক কার্যকলাপ। এই মুহূর্তে স্কুল-কলেজ, অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে আগামী প্রজন্ম এক গভীর খাদে হারিয়ে যাবে। আইপিএল একসময় ছিল বিনোদনের উৎস, এখন তা এক শ্রেণির মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে ধ্বংসের হাতিয়ারে। আর প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা বহু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
শহরবাসীর একটাই দাবি, এই ব্যাধির শিকড়ে কোপ মারুন, জুয়া বন্ধ হোক, যুবসমাজকে রক্ষা করুন। শহরের সচেতন নাগরিক সমাজ বলছেন, এটা কেবল একটা অবৈধ ব্যবসা নয়, বরং একটা প্রজন্মকে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। প্রশাসন যদি এবারও নির্বিকার থাকে, তাহলে আগামী দিনে যুবসমাজকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে আইপিএল শুধুই এক খেলার আসর নয়, শিলচরের এক অংশে তা পরিণত হয়েছে একটি বিপজ্জনক নেশায়। এখন প্রশাসন কতটা দ্রুত এই সমস্যার সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।