
ড. নিখিল দাশ শিলচর ১৯এপ্রিল:কাছাড় জেলার কালাইন এলাকা আবারও লাল মাটি পাচার চক্রের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এবার শিরোনামে এসেছে লালমাটি পাচারের ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্য। এলাকাবাসীর দাবি—বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই অঞ্চলে দিনের আলো থেকে গভীর রাত অবধি ধূমায়িত হচ্ছে লরি, ট্রাক ও ট্রাক্টর, আর সেইসব গাড়ি বোঝাই করে পাচার হচ্ছে লালমাটি।
বন বিভাগের আধিকারিকের চোখের সামনে দিয়ে এমন অবাধে পাচার চলছে যে, দেখলে মনে হয় যেন এই কাজ আইনসিদ্ধ কোনও ব্যবসা! সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল—এই অবৈধ লেনদেনের মূল পথ হয়ে উঠেছে কালাইন বন বিভাগের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়া প্রধান রাস্তাটি। চোখের সামনে এমন কর্মকাণ্ড ঘটতে থাকলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা যেন চুপচাপ বসে আছেন। স্থানীয়দের প্রশ্ন, বন বিভাগের চোখে কি ধুলো পড়েছে? নাকি টাকার বিনিময়ে তারা চোখে বুঁজে আছে?

একজন গ্রামবাসী বলেন, প্রতিদিন আমরা দেখি কেমন করে সারি সারি গাড়ি মাটি বোঝাই করে বন দপ্তরের সামনেই দিয়ে চলে যায়। একটাও চালান নেই, বৈধ কাগজপত্র নেই—তারপরেও বন বিভাগ ও প্রশাসনের কোনও তৎপরতা নেই! তাঁর আরও বক্তব্য, রাতে তো শব্দে ঘুমানো যায় না। যেন কোনও খনির কাজ চলছে এখানে। এই চোরাচালান যে শুধু পরিবেশের ক্ষতি করছে তাই নয়, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এলাকার কৃষি জমি, গড়ে উঠছে বড় বড় খাদ, মাটির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভরসা করে জমিতে ফসল ফলানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। আর প্রশাসনের এই নির্লিপ্ত ভূমিকা আরও উদ্বেগজনক।
কালাইন অঞ্চল যেন পাহাড় কেটে ধ্বংসের মুখে! প্রতিদিনই একাধিক জেসিবি মেশিন দিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড় কেটে কেটে লালমাটি সংগ্রহ করছে একদল বন মাফিয়া। এই বেআইনি কর্মকাণ্ডে একদিকে যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বনাঞ্চলের গাছপালা, অন্যদিকে ধীরে ধীরে ধ্বংস হচ্ছে প্রাণী ও পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সকাল হলেই শুরু হয় জেসিবি মেশিনের গর্জন।

জঙ্গল কাঁপিয়ে একটার পর একটা গাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছে। মাটির গায়ে আঁচড় কেটে কেটে লরি ভর্তি করে পাচার হচ্ছে লালমাটি। অথচ প্রশাসনের ভূমিকা দেখলে মনে হয়, যেন কিছুই দেখছে না তারা। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, পাহাড় কেটে মাটি তোলার ফলে ওই এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে, নদী-নালার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে, এবং জলস্তরেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, এই অঞ্চলের জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য ধীরে ধীরে লোপ পেতে বসেছে।
স্থানীয় এক পরিবেশপ্রেমী জানান, আগে এখানে পাখির কলরব শোনা যেত, এখন শুধু মেশিনের শব্দ আর ধুলোয় ঢেকে থাকা আকাশ। বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন যদি এখনই কড়া ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই এলাকা একদিন মানব বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়ায় এই অবৈধ মাটি পাচার চলছে। টাকা আর প্রভাবের কাছে যেন হার মেনেছে আইন ও প্রশাসন।
গ্রামের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে গেলেও হুমকি-ধামকি দিয়ে তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কাছাড় জেলার কালাইন এলাকায় প্রতিদিন চোখের সামনে পাহাড় কেটে লালমাটি পাচার হলেও প্রশাসনের ভূমিকা রয়ে গেছে কার্যত নীরব। সূত্রের খবর অনুযায়ী, মাঝে মধ্যে লোকদেখানো ভাবে এক-দুটি চালান কাটা হলেও, প্রকৃতপক্ষে সারাদিন ধরেই নির্বিঘ্নে চলছে লালমাটি বহনের কাজ। এই চোরাচালান থেকে সরকার যে রাজস্ব পেতে পারত, তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনই।
এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে ধ্বংস হচ্ছে এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সচেতন নাগরিকরা ইতিমধ্যেই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং কাছাড় জেলার জেলা শাসক মৃতুল যাদবের কাছে লিখিত ভাবে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাঁদের দাবি, দ্রুত এই চক্রটিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক এবং পাহাড় কাটার কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা হোক।
তবে প্রশ্ন উঠছে—প্রশাসন এতদিন কোথায় ছিল? কেন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে? নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো অঘোষিত মদত? স্থানীয়দের মতে, পাহাড় কাটা ও মাটি পাচারের সঙ্গে যুক্ত গাড়িগুলি প্রতিদিন নির্দ্বিধায় চলাচল করছে। কোথাও কোনো পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ নেই, নেই বন বিভাগের কোন নজরদারি। ফলে, প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে গভীর সন্দেহ ও ক্ষোভ।
অন্যদিকে, বন বিভাগ ও পুলিশের তরফে এখনও পর্যন্ত কোনও সদর্থক পদক্ষেপের খবর পাওয়া যায়নি। না কোনো অভিযান, না কোনো আটক, না কোনো তদন্ত। ফলে এই পাচার চক্র আরও সাহস পাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, যদি বন দফতরের অফিসের সামনেই এত বড়ো কারবার অনায়াসে চলতে পারে, তবে জেলার অন্য প্রান্তে কী অবস্থা? কালাইন কি তাহলে পাচারকারীদের জন্য এক ‘সেফ জোন’ হয়ে উঠেছে?