
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ৫ সেপ্টেম্বরঃ
দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতীক, স্বাধীনতার রক্তে লেখা ত্রিবর্ণ পতাকা, তারই অবমাননার চিত্র দেখা গেল শিলচরের রাঙ্গিরখাড়ি চত্বরে সদ্য উন্মোচিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তির সামনে। মঙ্গলবার সকাল থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় উড়তে থাকে। স্থানীয়রা যখন ক্ষুব্ধ, তখন প্রশাসন ও শাসকদলীয় নেতৃত্ব নীরব দর্শকের ভূমিকায়। নেতাজি মূর্তি উন্মোচনের দিন উৎসবের রঙে রাঙ্গিরখাড়ি চত্বর যেন মেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল। আলো, সাজসজ্জা, মঞ্চ, ঢোল-তাশার ভিড়ে কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু উৎসবমুখর এই আয়োজনের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল প্রকল্পের ভিত কতটা নড়বড়ে। জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষার মতো সামান্য পরিচর্যার কাজও সেখানে নিশ্চিত করা হয়নি।
প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, পতাকার খুঁটির উপরের পুলি বা চাকতি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পতাকা ঠিকভাবে উত্তোলিত হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, যদি সত্যিই তাৎক্ষণিক ত্রুটি হয়ে থাকে, তবে তা কয়েক মিনিটে মেরামত করা যেত না? কেন ঘন্টার পর ঘন্টা পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় উড়তে থাকল? কেন কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃত্ব সময়মতো পদক্ষেপ নিল না? ঘটনা নিয়ে শাসকদলের এক প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি একে আকস্মিক বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, আকস্মিক বলেই কি জাতীয় পতাকা অবমাননা করা যাবে?
দেশপ্রেমের প্রতীক কি এতটাই তুচ্ছ? আরও বিস্ফোরকভাবে, ওই প্রতিনিধির মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, উন্মোচনের দিনও চাকতি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেই সমস্যাই আবার হয়েছে। অর্থাৎ নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের দিন থেকেই এই যান্ত্রিক ত্রুটির ব্যাপারে জানা ছিল। তবুও পরবর্তী সময়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তা হলে কি জাতীয় পতাকার প্রতি এই চরম অবহেলা শুধুই অব্যবস্থাপনা, নাকি ইচ্ছাকৃত গাফিলতি?
ঘটনা ঘটতেই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ঝড় তুলতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ সরব হন পতাকার এই অপমানের বিরুদ্ধে। এরপর প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা অর্ধনমিত অবস্থায় থাকার পর অবশেষে প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা পতাকা সঠিকভাবে উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরে। এখানেই শেষ নয় বিতর্ক। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছিল। অথচ সেই অর্থের একটি বড় অংশ শিলচরের বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর নামে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা সরকারি তহবিলে দান করেছেন।
প্রশ্ন উঠছে, তাহলে চাঁদা তোলার উদ্দেশ্য কি সত্যিই মূর্তি স্থাপন ও তার রক্ষণাবেক্ষণ, নাকি রাজনৈতিক প্রচারের অজুহাতে সরকারি তহবিলে দান প্রদর্শন করা? যখন কোটি কোটি টাকা সরকারি প্রকল্পে ব্যয় করা হচ্ছে, তখন জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ কেন মুখ্যমন্ত্রীর তহবিলে চলে যাবে? সেই অর্থ দিয়ে কি পতাকার মর্যাদা রক্ষা কিংবা স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না? সাধারণ মানুষ এখন হিসেব চাইছে, চাঁদা তোলার নামে কত টাকা উঠেছিল, আর তা কোথায় ব্যয় হলো? স্থানীয়দের অভিযোগ, নেতাজির মূর্তি আসলে শাসকদলের রাজনৈতিক মুনাফার হাতিয়ার মাত্র।
উন্মোচনের দিনে ছিল আড়ম্বর আর জনসমাগম, কিন্তু তার পরেই অবহেলা, অপমান আর উদাসীনতা। দেশপ্রেমিক নেতার মূর্তি যদি কেবল ভোটের বাজার গরম করার জন্য ব্যবহার হয়, তবে তা জাতীয়তাবোধের পরিপন্থী বলেই দাবি করছেন সচেতন মহল। জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার ঘটনায় প্রশাসন ও নেতৃত্বের নীরবতা এখন সর্বজনীন বিতর্কের কেন্দ্রে। দেশ যে পতাকার জন্য এত রক্ত দিয়েছে, সেই পতাকা ঘন্টার পর ঘন্টা অর্ধনমিত অবস্থায় অবমানিত হবে আর কর্তৃপক্ষ চুপ করে থাকবে,
এ দৃশ্য বেদনাদায়ক তো বটেই, লজ্জাজনকও। নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের গৌরবময় দিনে যে দেশপ্রেমের আবেগ ছড়িয়েছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আবেগে বড় দাগ কেটে দিল এই অর্ধনমিত পতাকার ঘটনা। প্রশাসন ও শাসকদলের ওপর মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, নেতাজি কি কেবল রাজনৈতিক মঞ্চের প্রতীক, নাকি সত্যিই আমাদের আত্মমর্যাদার অনন্ত প্রেরণা?