
বরাকবাণী প্রতিবেদন লক্ষীপুর, ৫ সেপ্টেম্বর : বরাক উপত্যকার চা জনগোষ্ঠীর বার্ষিক করম পূজা ঘিরে এবার প্রকাশ্যে ফেটে বেরোল লক্ষীপুর বিজেপির অন্দরের লড়াই। পূজার জন্য মাটি পূজার আয়োজন হলেও শেষ মুহূর্তে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় কার্যত স্থগিত হয়ে গেল অনুষ্ঠান। এ ঘটনা কেন্দ্র করে একদিকে ক্ষুব্ধ চা জনগোষ্ঠী, অন্যদিকে মুখে কুলুপ এঁটেছেন সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকরা। কিন্তু স্থানীয় মহলে আলোচনা, এর আড়ালে লুকিয়ে আছে বিজেপির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
চা শ্রমিক সংগঠন বহু বছর ধরে ভাদ্রমাসে আনুষ্ঠানিকভাবে করম পূজার আয়োজন করে আসছে। এবছর সেই পূজার আসর বসার কথা ছিল লক্ষীপুর বাগানে। আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট মাঠে মণ্ডপ গড়ার প্রস্তুতিও চলছিল। আজ ছিল ভূমি পূজার দিন। কিন্তু আচমকাই বাধা পড়ল। মাঠে উপস্থিত আয়োজকরা অভিযোগ করেন, পূজার অনুমতি থাকলেও স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা এসে জানান—সেই মাঠে এবার অনুষ্ঠিত হবে এমএলএ কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা।
তাদের যুক্তি, গত বছর খেলার মাঠে সংঘর্ষের কারণে এবছর নতুন স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠ কর্দমাক্ত হওয়ায় পূজার জন্য উপযুক্ত নয় বলে মত দেন। এমনকি তারা পূজার জন্য বিকল্প মাঠ খুঁজে নিতে বা সরাসরি মন্ত্রী কৌশিক রায় ও প্রাক্তন বিধায়ক রাজদীপ গোয়ালার সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেন। ফলে বাধ্য হয়ে পূজার আয়োজকরা নতুন জায়গা খুঁজতে নামলেও সংবাদ লেখা পর্যন্ত অন্য কোনো জায়গা চূড়ান্ত করা যায়নি।
চা জনগোষ্ঠীর কাছে করম পূজা শুধুই একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক সংহতির প্রতীক। অথচ এই উৎসবকে ঘিরেই প্রকাশ্যে এসেছে রাজনৈতিক কচকচানি। অভিযোগ উঠছে, স্থানীয় মন্ত্রী তথা লক্ষীপুরের বর্তমান বিধায়ক কৌশিক রায়ের ইঙ্গিতেই পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা বাধা দেন। কারণ, পূজার মূল উদ্যোক্তা চা শ্রমিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাজদীপ গোয়ালা লক্ষীপুরের প্রাক্তন বিধায়ক এবং সম্প্রতি বিজেপিতে যোগদানকারী নেতা।

রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, করম পূজার মতো সামাজিক উৎসবের মাধ্যমে রাজদীপের জনপ্রিয়তা বাড়লে আসন্ন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় তার অবস্থান আরও মজবুত হতে পারে। সেই আশঙ্কাতেই মন্ত্রী শিবির মাঠে নেমে অনুষ্ঠানকে আটকে দিয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধী মহলে। লক্ষীপুর রাজনীতির অভ্যন্তরীণ চিত্র খুব স্পষ্ট, দলীয় আনুষ্ঠানিকতায় রাজদীপকে তেমন ডাকা হয় না, গুরুত্বও দেওয়া হয় না। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি অনেকটাই আড়ালে। তবে মঞ্চে বা মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় তাকে। এবার করম পূজা ঘিরে তার নাম ফের আলোচনায় উঠে আসায় মন্ত্রীর শিবির অস্বস্তিতে পড়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে, চা জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ বাড়ছে। তাদের মতে, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার বানানো হচ্ছে। অনুমতি থাকা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে পূজা ঠেকানো তাদের ভাবাবেগে আঘাত। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—ফুটবল প্রতিযোগিতা কি ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে বড়? যদিও রাজদীপ গোয়ালা এ ব্যাপারে এখনও কোনো মন্তব্য করেননি। মন্ত্রী কৌশিক রায়কেও যোগাযোগ করা হলেও তার কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের বক্তব্য, পূজার আয়োজন থামানো তাদের উদ্দেশ্য নয়, মাঠের ব্যবহার নিয়ে জটিলতার কারণেই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ঘটনাটি যে শুধুমাত্র একটি মাঠ নিয়ে দ্বন্দ্ব নয় তা স্পষ্ট। বিজেপির ভেতরকার শক্তি পরীক্ষা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং আসন্ন নির্বাচনী সমীকরণই আসল কারণ বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। প্রশ্ন উঠছে, করম পূজা বাধাগ্রস্ত হলেও কি রাজনৈতিক মাটি শক্ত করলেন রাজদীপ? নাকি মন্ত্রীর শিবিরের কৌশলেই তাকে আরও আড়ালে ঠেলে দেওয়া হল? এখন দেখার বিষয়, চা জনগোষ্ঠীর আবেগে আঘাত লাগার ফলশ্রুতিতে রাজনীতির সমীকরণ কোনদিকে গড়ায়। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, লক্ষীপুরে করম পূজা ঘিরে এই সংঘাত বিজেপির অন্দরের কাঁটাতারের রাজনীতিকে আরও স্পষ্ট করে দিল।