
বরাকবাণী প্রতিবেদন গুয়াহাটি, ৫ মেঃ চলতি বছরে রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণের আগের দিনই পুনরায় বিপুল অঙ্কের ঋণ নিতে চলেছে অসম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বাধীন সরকার এইবার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ নিতে চলেছে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছ থেকে। এই ঋণ ২০ বছরের মেয়াদের জন্য বন্ড বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।
ইতিমধ্যেই অর্থ বিভাগ এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এই নিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকারের এটি দ্বিতীয় ঋণ গ্রহণ। এর আগে, অর্থবর্ষের প্রথম মাসে অর্থাৎ ২২ এপ্রিল, সরকার ৯০০ কোটি টাকার একটি ঋণ নিয়েছিল।
অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের অন্তিম মাস মার্চেই সরকার ৩,৩০০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। আবার ফেব্রুয়ারিতে ৩,৬৫০ কোটি টাকার আরও একটি ঋণ নেওয়া হয়েছিল। ধারাবাহিকভাবে এই বিপুল ঋণ গ্রহণে রাজ্যবাসীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে অসম সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ ঋণ শুধু যে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট করছে তাই নয়, বরং সুদের বোঝাও রাজ্যের রাজকোষে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একের পর এক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্য সরকারের আর্থিক রণকৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ভোটের আগে একদিকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা, অপরদিকে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের নির্ভরতা শুধুমাত্র ঋণের ওপর—এই প্রবণতা আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সরকার যদিও দাবি করছে যে এই ঋণগুলি পরিকাঠামো উন্নয়ন, সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প এবং কর্মসংস্থানের খাতে ব্যয় হবে, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে নানা মহলে সন্দেহ রয়েছে। বিশেষ করে তখনই, যখন গত ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ তারিখে গৌহাটির খানাপাড়ায় অনুষ্ঠিত হওয়া ‘অ্যাডভান্টেজ অসম ২.০’ নামক বৃহৎ বিনিয়োগ সন্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেছিলেন—রাজ্যে মোট ৫.১৮ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায় তখন মনে হয়েছিল রাজ্যের উন্নয়ন পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বিনিয়োগের সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই সরকার পুনরায় একের পর এক ঋণ নিতে শুরু করায় সেই আশার জায়গায় ভর করেছে প্রশ্নচিহ্ন।
২০১৬ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্য সরকারের ঋণ ও সুদের হিসাব এক বিপুল অঙ্কে গিয়ে ঠেকেছে। গত আট বছরে রাজ্য সরকারকে শুধুমাত্র সুদের খাতেই ৪২,০৬১ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের পাঁচ বছরে সরকার সুদের জন্য খরচ করেছিল ১৯,৬৫১ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মাত্র তিন বছরে সেই অঙ্ক ছাপিয়ে গিয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে সুদের জন্য ইতিমধ্যেই ২২,৪১০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই হিসাব থেকেই স্পষ্ট, ঋণের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনই সুদের বোঝাও এক ভয়ানক হারে বেড়েছে। প্রতি অর্থবর্ষেই রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ কেবল সুদের খাতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে, যা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণকে সীমিত করে দিচ্ছে।
বিনিয়োগ সম্মেলনের পর রাজ্যবাসী আশা করেছিল, বহুদিন পরে এবার রাজ্যে শিল্প আসবে, কর্মসংস্থান হবে, রাজস্ব আয় বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকার তার নিজস্ব খরচ মেটানোর জন্য আবার ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে। ফলত, ‘উন্নয়ন’ শব্দটি শুধুই সরকারি প্রচারে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজ্য সরকারের এই ঋণনীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনায় মুখর। তাদের মতে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নানা প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং প্রশাসনিক ব্যয় সামলাতে সরকারের এই ঋণ নেওয়ার তাড়াহুড়ো। জনগণের করের টাকায় সুদ শোধ করতে শোধ করতে শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ব্যয় সংকুচিত হয়ে পড়বে।
বিপুল ঋণ এবং সুদের ফাঁদ থেকে রাজ্যকে মুক্ত করার জন্য কোনও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা সরকারের হাতে নেই বলেই মনে করছে বিরোধীরা। অতএব প্রশ্ন উঠছে, এই ধারাবাহিক ঋণগ্রহণ কি রাজ্যের ভবিষ্যতের উপর এক গভীর সংকটের ছায়া ফেলছে না?
বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের ঘোষণা যতই হোক, সরকার যদি তার নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে না পারে, তাহলে এই ঋণ একসময় মহাবিপদ ডেকে আনবে। এখন দেখার বিষয়, আগামিদিনে রাজ্য সরকার শুধুমাত্র ঋণ নেওয়ার নীতিতে চলবে, না কি সে নিজেকে আর্থিকভাবে আত্মনির্ভর করার কার্যকরী পথ খুঁজে বের করবে।