
বরাকবাণী প্রতিবেদন গুয়াহাটি ৪ মেঃ ভারতের সংবাদ মাধ্যম আজ এক গভীর সংকটে। একদিকে সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ছে, টিভি থেকে অনলাইন মাধ্যমে ঘটছে বিপ্লব, অথচ অন্যদিকে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। এই বাস্তব চিত্রটি আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস্ (RSF)-এর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক ২০২৫-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়েছে।
RSF-এর ভাষায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের স্বঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান এখন ১৫১ নম্বরে। যদিও এটি গত বছরের ১৫৯ তম স্থান থেকে কিছুটা উন্নতি, কিন্তু রিপোর্টে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত গুরুতর।
এই প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে তথাকথিত ‘গোদি মিডিয়া’ বা সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে। এগুলো নির্দ্বিধায় সরকারের পক্ষ নিয়ে প্রচার চালায়, বিরোধী মত দমন করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংবাদ সম্মেলন প্রায় করেন না। যারা তার সাক্ষাৎকার নেন, তারাও প্রায়শই সরকারপন্থী এবং প্রশ্নবিদ্ধ।
মিডিয়া জগতেও কর্পোরেট শক্তির দখল বেড়েছে। দেশের অন্যতম ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি ৭০টির বেশি সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছেন। অন্যদিকে, গৌতম আদানির মালিকানায় চলে গেছে NDTV-র মতো এক সময়ের নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম। এর ফলে ভিন্নমত বা বিকল্প কণ্ঠ ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বৈচিত্র্য বা মতামতের বহুবিধতা আজ চরম সংকটে।
সরকার ২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং ২০২৩ সালে ডিজিটাল প্রাইভেসি সুরক্ষা আইন এনে অনলাইন সংবাদ ও কনটেন্টের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বসিয়েছে। ফলত, অনেক সাংবাদিক বা ব্লগার এখন সেল্ফ-সেন্সরশিপে বাধ্য হচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা করলেই তাদের হুমকি, গালিগালাজ, এমনকি গ্রেপ্তারের মুখে পড়তে হচ্ছে।
কাশ্মীরের সাংবাদিকদের অবস্থা আরও করুণ। যাঁরা স্থানীয় সমস্যা বা সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাঁদের পুলিশি হয়রানি, নজরদারি এমনকি অবৈধভাবে আটকে রাখাও হচ্ছে। অনেক সময় সাংবাদিকদের ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক চাপে রাখা হয়।
প্রতিবছর ভারতে গড়ে দুই থেকে তিনজন সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত কারণে খুন হন। ফলে, ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম সাংবাদিক-অবন্ধু দেশ হিসেবে পরিচিত। এমনকি অনেক ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যা দোষীদের সাহস বাড়িয়ে তোলে।
এখনকার তরুণ প্রজন্ম টিভি বা সংবাদপত্রের বদলে খবর পড়ে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। অথচ এই মাধ্যমগুলিও সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণে পড়ে যাচ্ছে। প্রায় ২১ কোটি টিভি দর্শক ও ৩৯ কোটির বেশি সংবাদপত্রের প্রচার থাকা সত্ত্বেও, সংবাদমাধ্যম এখন আর সাধারণ মানুষের কথা বলে না—বলছে সরকারের ভাষায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম হল চতুর্থ স্তম্ভ। সেটি যদি ভেঙে পড়ে, তবে পুরো গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ভারতের প্রেক্ষাপটে আজ সেই শঙ্কাই ঘনীভূত হয়েছে।
RSF-এর এই প্রতিবেদন শুধু একটিমাত্র রেটিং নয়, বরং ভারতের গণতন্ত্রের এক জ্বলন্ত সতর্কবার্তা। যাঁরা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারে বিশ্বাসী, তাঁদের জন্য এটি গভীর চিন্তার বিষয়। আজ যদি এই বিপজ্জনক প্রবণতা থামানো না যায়, কাল হয়তো ভারতের সাংবাদিকতা একেবারেই নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমে পরিণত হবে—যেখানে থাকবে না কোনও প্রশ্ন, থাকবে শুধু শাসকের উত্তর।