পুরসভার কাজকর্মে বিজেপি কমিশনরাজ চালাচ্ছে, অভিযোগ জেলা কংগ্রেসের

ড্রেন নির্মাণ সহ গান্ধী মেলার টেন্ডারের নামে ব্যাপক দুর্নীতি

বরাকবাণী প্রতিবেদন,শিলচর,১ ফেব্রুয়ারি: শিলচর শহরের দীর্ঘদিনের উন্নয়নহীনতা ও শাসকদলের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে জেলা কংগ্রেস কমিটি। বৃহস্পতিবার শিলচর জেলা কংগ্রেস ভবনে আয়োজিত এক সাংবাদিক বৈঠকে দলীয় মিডিয়া ইনচার্জ দেবদীপ দত্ত, প্রাক্তন পুর কমিশনার সজল আচার্যসহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। সাংবাদিক বৈঠকে যুব কংগ্রেস সভাপতি রণজিত দেবনাথ, অনুপম পাল, রঞ্জিত দেবনাথ, অভীক দাস, অৰ্কদীপ রায় চৌধুরীসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। দেবদীপ দত্ত অভিযোগ করে বলেন, “শাসকদল শহরের উন্নয়নের নামে শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে, অথচ বাস্তবে কোনো কাজ হচ্ছে না। জেলা কংগ্রেস সভাপতি অভিজিৎ পালের নেতৃত্বে বিগত কয়েক মাস ধরেই আমরা শিলচরের নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছি। কিন্তু সরকারি উদাসীনতা এখনও কাটেনি। কংগ্রেস নেতারা উল্লেখ করেন, শহরের বিভিন্ন সড়কের বেহাল দশা, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ, স্বাস্থ্য ও পানীয় জলের সংকটসহ বহু সমস্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি শহরের একাধিক এলাকায় রাস্তার উন্নয়নকাজ শুরু হলেও, তা ধীরগতিতে চলছে এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ উঠছে। সজল আচার্য বলেন, “শিলচর শহরকে স্মার্ট সিটি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার, অথচ আজ শহরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্ষার মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই জল জমে যায়, ফুটপাথগুলো ধসে পড়ে, এবং বাজার এলাকাগুলো হাঁটার অনুপযোগী হয়ে ওঠে। অথচ প্রশাসন এ নিয়ে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কংগ্রেস নেতারা সরাসরি অভিযোগ করেন যে, শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের কথা না শুনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত। অভিজিৎ পালের নেতৃত্বে জেলা কংগ্রেস শহরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। দেবদীপ দত্ত আরও বলেন, আমরা চুপ করে বসে থাকব না। শাসকদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। যদি প্রশাসন দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বৃহত্তর গণআন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। শিলচরের সাধারণ মানুষও কংগ্রেসের এই অভিযোগের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছে। বহু বাসিন্দা জানিয়েছেন, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কারণে তারা প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন। জেলা কংগ্রেস জোর গলায় বলেছে যে, তারা শাসকদলের প্রতিটি ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরবে এবং প্রয়োজন হলে বৃহৎ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মুখে দাঁড় করাবে। শিলচর শহরের প্রকৃত উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে বলে তারা জানায়।

শহরের সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের কাজ, তেমনি সম্প্রতি গান্ধী মেলা পরিচালনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন সংগঠন যখন এ বিষয়ে সরব হয়ে ওঠেছে, তখন সেটা সহ্য হচ্ছে না শিলচর বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তীর। তাঁর নেতৃত্বে শিলচর পুরসভা যেন এক দুর্নীতির আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে। গান্ধী মেলা পরিচালনায়ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে, মেলায় বিনোদন সামগ্রী বসানোর বরাত নিয়ে চরম অনিয়ম হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই বরাত দেওয়ার পেছনে যে সুবিধা আদায় এবং দুর্নীতি চলছে, তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

শিলচর জেলা কংগ্রেস আর ও গুরুতর অভিযোগ করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন শিলচর শহরের নাগরিক জীবন এখন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার শিকার। বিশেষ করে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন পুরসভার কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। ড্রেন নির্মাণ থেকে শুরু করে রাস্তা সংস্কার, সমস্ত প্রকল্পেই দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ বিজেপি নেতারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কমিশনরাজের অভিযোগ তুলে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী ও বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক অভ্রজিৎ চক্রবর্তী কংগ্রেস পরিচালিত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে গান্ধী মেলা পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। কংগ্রেসের আমলে পুরসভার আয়-ব্যয়ের হিসাব স্বচ্ছ ছিল। ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কংগ্রেস পরিচালিত পুর বোর্ডের সময় গান্ধী মেলার হিসাব নিয়মিত প্রোফিট অডিটেক্ট করা হতো। তখনকার আয় ছিল যথাক্রমে—

২০১৪ সালে: ১৪,২১,৫৮৮ টাকা

২০১৩ সালে: ৯,০৭,৪৮৮ টাকা

২০১২ সালে: ১১,৬৩,৮০০ টাকা

২০১০ সালে: ১০,৬৩,০০০ টাকা

২০০৫ সালে: ১৩,৩৭,০০০ টাকা

এসব তথ্যই প্রমাণ করে যে কংগ্রেস পরিচালিত শিলচর পুরসভা গান্ধী মেলার আয়-ব্যয় পরিচালনায় স্বচ্ছতা বজায় রেখেছিল। বর্তমান পুরসভায় দুর্নীতি এতটাই ব্যাপক আকার নিয়েছে যে, শহরের বাসিন্দারা রীতিমতো আতঙ্কিত। বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হচ্ছে, অথচ প্রশাসন নির্বিকার। শিলচর শহরের ড্রেন নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সঠিকভাবে কাজ করা হচ্ছে না। নির্মাণকাজের গুণমান অত্যন্ত নিম্নমানের। বৃষ্টি হলেই রাস্তাঘাট জলমগ্ন হয়ে পড়ে, ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হন। শহরের রাস্তাগুলি দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু রাস্তা সংস্কার করা হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই তা ভেঙে যায়। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে এবং কাজের নামে টাকা লুট করা হচ্ছে। কংগ্রেস আমলে গান্ধী মেলার টোল ফি ছিল নাগালের মধ্যে। চরকির ভাড়া ছিল মাত্র ২০ টাকা, এখন তা বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। মত কি কুয়ার ভাড়া ছিল ২০ টাকা, এখন তা ৮০ টাকা। অর্থাৎ, বর্তমান বিজেপি পরিচালিত পুরসভা জনগণের পকেট কেটে আয় বাড়াচ্ছে, অথচ প্রকৃত উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া নেই।

বর্তমান শাসক দল উন্নয়নের বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে শিলচর শহর দিন দিন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হচ্ছে। বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী যখন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলেন, তখন তা কৌতুকের মতো শোনায়। কারণ বর্তমান পুরসভায় কমিশন রাজ কায়েম হয়েছে, যেখানে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে নিম্নমানের কাজ করানো হচ্ছে। জনগণের টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিত্তশালী হচ্ছেন, আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত নাগরিক সুবিধা থেকে। শিলচর পুরসভার এই দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষয়গুলো জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিলচর শহরের উন্নয়নের স্বার্থে জনগণের উচিত সচেতন হয়ে এই দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। না হলে আগামী দিনে শহর আরও অব্যবস্থাপনার কবলে পড়বে।

  • Related Posts

    মিয়ানমারের ৪.৭ মাত্রার রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল মণিপুর, নাগাল্যান্ড সহ আসাম, এখনো হতাহতের খবর নেই, আতঙ্কে বহু মানুষ

    বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ৩০ সেপ্টেম্বরঃ মঙ্গলবার ভোরে হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। সকাল ৬টা ১০ মিনিটের সময় বহু মানুষ এখনো ঘুমের রাজ্যে। সেই সময় আচমকা কেঁপে ওঠে মাটি। প্রথমে…

    শিলচর ডিসি অফিসে বাবু সিণ্ডিকেটের চাঁই সৌমিত্র নাথ ধর্ষণ অভিযোগে গ্রেফতার

    বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর, ৩০ সেপ্টেম্বরঃ শিলচর শহর কেঁপে উঠেছে জেলা কমিশনারের কার্যালয়কেন্দ্রিক এক নারীর প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনায়। সরকারি দফতরের ভেতরেই যখন নারী সহকর্মী নিরাপদ নন, তখন সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার…