
বরাকবাণী প্রতিবেদন শিলচর ৯ মেঃ শুদ্ধতা, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার মুখোশ পরে একের পর এক ভয়ংকর অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ উঠল প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী শিলচর (চাঁদমারি) সেন্টারের প্রধান পরিচালিকা জেউতি কলিতার বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে চাঁদমারি সেন্টারের একাংশ ভক্তের মুখে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর একের পর এক তথ্য।
অভিযোগ, আধ্যাত্মিকতার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছেন এক প্রলোভনময় প্রতারণার সাম্রাজ্য। ভক্ত রিপন নাথ, সুমন্ত পাল, পীযূষ চৌধুরী, রামানুজ ভট্টাচার্য, মুন্না দেবনাথ, সুব্রত নাথ এবং জয়া ভট্টাচার্য একযোগে অভিযোগ করেন, যোগীর বেশে ভোগীর জীবন কাটাচ্ছেন জেউতি কলিতা।
শিষ্যদের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। কেউ জমি হারিয়েছেন, কেউ নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দিয়েছেন এই সেন্টারের নামে। অভিযোগের তালিকা ভয়াবহ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বহিরাগত লোক এনে নিয়মিত শরীর মালিশ করানো।

শিষ্যদের কাছ থেকে রসিদহীন ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা সংগ্রহ। শিষ্য ও শিষ্যপত্নীদের প্ররোচিত করে স্বামীদের পকেট থেকে টাকা তুলে এনে সেন্টারে দান করানো। একনায়কতান্ত্রিক ভাবে সেন্টার পরিচালনা করে আধ্যাত্মিকতার বদলে অর্থ উপার্জনকে প্রধান লক্ষ্য করা। মিথ্যাচার, প্রতারণা ও মানসিক দমনপীড়ন ব্যবহার করে শিষ্যদের নিয়ন্ত্রণ করা।
ভক্তদের মতে, এই ভণ্ডামির জাল ছড়িয়ে জেউতি কলিতা চাঁদমারি সেন্টারকে আধ্যাত্মিক আশ্রমের বদলে একটি অর্থ সংগ্রহ কেন্দ্র ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির মঞ্চে পরিণত করেছেন। এই কাজে তাকে মদত দিয়ে চলেছেন সুসীম নাথ, সৌমেন পালচৌধুরী সহ আরও কিছু ঘনিষ্ঠ শিষ্য।

সুসীম নাথের বিরুদ্ধে শহরের দ্বিতীয় লিংকরোড এলাকায় জলজীবন মিশনের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বেআইনিভাবে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, সৌমেন পালচৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে এক অসহায় বিধবার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ।
অভিযোগ, এদের সঙ্গে জেউতি কলিতার রয়েছে গোপন অর্থনৈতিক ও স্বার্থগত সমঝোতা। ভক্তদের সাফ কথা–আর নয়। এই অধর্ম আর বরদাস্ত করা হবে না। জেউতি কলিতাকে অবিলম্বে শিলচর সেন্টারের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় প্রয়োজনে আমরা গুয়াহাটি গিয়ে অবস্থান ধর্মঘটে বসব।
আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, আত্মশুদ্ধি ও সেবার মন্ত্রে পরিচালিত ঈশ্বরীয় প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী চাঁদমারি রোড শাখা আজ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। এক নিঃসন্তান বৃদ্ধা শিষ্যার হৃদয়বিদারক অভিযোগ এবং তার জেরে সৃষ্ট চাঞ্চল্যে হতবাক শিলচরের সুশীল সমাজ। ৮৫ বছর বয়সী কণিকা শর্মা, যিনি এক সময় সরকারি চাকরিরত ছিলেন এবং অবসর গ্রহণের পর ব্রহ্মাকুমারীদের শিষ্যা হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন, সম্প্রতি বাঙালি নবনির্মাণ সেনার সহায়তায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্ফোরক অভিযোগ তোলেন।
তিনি জানান, চাকরির অবসরের পর ব্রহ্মাকুমারী সেন্টারের দেখভাল ও আধ্যাত্মিক কাজের স্বার্থে নিজের চাঁদমারি রোডের দ্বিতল বাড়ি দান করেছিলেন। বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল—সারা জীবনের জন্য তাঁকে দেখভাল করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল তার ঠিক উল্টো। ২০২২ সালের বিধ্বংসী বন্যার সময় তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন কণিকা দেবী। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ—সেন্টারের প্রধান পরিচালিকা জেউতি কলিতা। বৃদ্ধার কথায়, আধ্যাত্মিকতার মুখোশ পরে এরা যে কীভাবে প্রতারণা করতে পারে, তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

সাংবাদিক সম্মেলনের ঠিক পরদিন, বাঙালি নবনির্মাণ সেনার কর্মকর্তা ও স্থানীয় সচেতন নাগরিকেরা সরাসরি সেন্টারে গিয়ে জেউতি কলিতাকে জবাবদিহির মুখে ফেলেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে, ঘটনাস্থলে হাজির হন একাধিক বিক্ষুব্ধ ভক্ত। তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দেন। ঘটনার জল গড়ায় আরও দূর।
পরদিনই পালটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সমস্ত অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেন জেউতি কলিতা। তবে তাতেও থামেনি বিতর্কের আগুন। এবার সেন্টারেরই একাংশ ক্ষুব্ধ ভক্ত প্রকাশ্যে মুখ খোলেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, জেউতি কলিতা ব্যক্তিগত স্বার্থে সেন্টার পরিচালনা করছেন এবং আধ্যাত্মিকতার নামে একক কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন।
একজন ভক্তের প্রশ্ন, যেখানে ঈশ্বরের নাম করে ঠাঁই দেওয়া হয়, সেখানে কীভাবে একজন বৃদ্ধা শিষ্যাকে ঘরছাড়া করা যায়? স্থানীয় সুশীল মহলে প্রশ্ন উঠেছে—এটাই কি তবে আত্মশুদ্ধির পথ? ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও কণিকা দেবীর ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন মানবাধিকার কর্মীরাও। শিলচরের আধ্যাত্মিক মহলে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকের মত, ধর্মের নামে ব্যবসা ও ক্ষমতার রাজনীতি যতদিন চলবে, ততদিন এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
একটা আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠানে যখন ঈশ্বরের নামের ছায়ায় মানুষ খোঁজে মানসিক শান্তি, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকেই যদি শোনা যায় মিথ্যাচার, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ—তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা কোথায় দাঁড়াবে?
চাঁদমারি রোডের প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী আশ্রমের প্রধান জেউতি কলিতার বিরুদ্ধে এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ এনে সরব হয়েছেন আশ্রমের ভক্ত ও একাংশ সদস্য। তাঁদের দাবি, আধ্যাত্মিকতার মুখোশ পরে দিনের পর দিন ভক্তদের বিভ্রান্ত করে চলেছেন জেউতি কলিতা।
সম্প্রতি প্রাক্তন সদস্যা কণিকা শর্মার আশ্রম ত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই জেউতি কলিতা দাবি করেন, তাঁকে নাকি তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি—তিনি নাকি মাঝেমধ্যে এসে বিশ্রাম নেন! এই দাবিকে চরম মিথ্যাচার বলে আখ্যা দিয়েছেন আশ্রমের একাংশ ভক্ত। তাঁদের বক্তব্য, এতসব ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কণিকা শর্মা এখনও আশ্রমের বাইরে। এটা বুঝতে রকেট সায়েন্স জানার দরকার নেই।
অবস্থার বেগ সামলাতে না পেরে জেউতি কলিতা ঘটনাটিকে অসমীয়া বিদ্বেষের রঙ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ। কিন্তু সংগঠনের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, ব্রহ্মাকুমারী সংস্থা এমন এক আধ্যাত্মিক পরিবার যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে দেখা হয়।
হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান—সকলেই এখানে জড়িত। ফলে অসমীয়া বিদ্বেষের অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর বলেই মত তাঁদের। জেউতি কলিতার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কণিকা শর্মার বিতাড়নই নয়, দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম, স্বজনপোষণ এবং একনায়কতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। একাধিকবার উপরমহলে অভিযোগ জানানো হলেও, রহস্যজনকভাবে আজও কোনও তদন্ত শুরু হয়নি।
এতে ভক্তদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ভক্তরা এখন দাবি তুলেছেন—চাঁদমারি রোড শাখা থেকে অবিলম্বে জেউতি কলিতাকে অপসারণ করতে হবে। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরণের বিতর্ক ও আর্থিক কেলেঙ্কারি সংগঠনের ভাবমূর্তিকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করছে।
ব্রহ্মাকুমারী সংস্থার আধ্যাত্মিক পরিবেশ যেখানে মানুষের আত্মিক উন্নয়নের পথ দেখায়, সেখানে এমন বিতর্ক ও দুর্নীতির অভিযোগ শুধু লজ্জাজনকই নয়, একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আশ্রমের পবিত্র পরিবেশকে কলঙ্কিত করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন সকলের দৃষ্টি উচ্চপর্যায়ের দিকে। আদৌ কি কোনও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে? অপরাধীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে? নাকি সব অভিযোগ ধামাচাপা পড়বে প্রভাবশালী কারো ছত্রছায়ায়?